আশি দশকের শুরুতেই ডা. জাফরুল্লাহর উদ্যোগে `সবার জন্য স্বাস্থ্য` নামের একটি সংগঠনের জন্ম হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, অত্যন্ত স্বল্প ব্যয়ে দেশের আপামর জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, ফরহাদ মজহার, ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল, ড. আজিজুর রহমান, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম, সাংবাদিক শাহাদৎ চৌধুরী, অধ্যাপক মনসুর মুসাসহ আরও কয়েকজন। এই সংগঠন ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি সর্বজনীন গণমুখী স্বাস্থ্য আন্দোলন। এটি ছিল বহুজাতিক ঔষধ কোম্পানিগুলোর নির্বিচার, লুন্ঠন ও শোষনের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা একটি জাতীয় আন্দোলন। এই আন্দোলন করতে গিয়ে জাফরুল্লাহকে অনেক হুমকির মুখোমুখি হতে হয়েছে। তারপরও তিনি এই আন্দোলন থেকে পিছপা হননি। এমনকি বাংলাদেশ মেডিকেল এসোশিয়েশন(বিএমএ)ও এই আন্দোলনের বিপক্ষে ছিল!
এই সংগঠনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৮১ সালে `গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল`নামে একটি বিশ্বমানের ঔষধ কোম্পানি গড়ে তোলেন। এই কোম্পানির উৎপাদিত সকল ঔষধের দাম অন্যান্য ফার্মাসিউটিকেলের চেয়ে প্রায় অর্ধেক ছিল এবং বর্তমানেও তা অটুট আছে। যেমন, কিডনি ডায়ালিসিসের জন্য অপিরহার্য ইনজেকশন হলো হেপারিন, যেটির বাজারে দাম ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা কিন্তু গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালে এই ঔষধটির দাম মাত্র ২০০ টাকা। পুড়া ও কাঁটা ক্ষত শুকানো অন্যতম ঔষধ হলো ফ্লুক্লসাসিলিন ক্যাপসুল। এই ঔষধ বাজার মূল্য ১০ টাকা আর গণস্বাস্থ্যের উৎপাদিত এর দাম মাত্র ৫.৫০ টাকা। এছাড়াও কোলেস্টেরেল কমানোর জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ঔষধ হলো এটরভাসটাটিন যার বাজার মূল্য ১১ টাকার কাছাকাছি কিন্তু গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালে এর দাম মাত্র ৭ টাকা। মোটামুটি বলা যেতে পারে, গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালের সব ঔষধই সাধারণ মানুষের জন্য ক্রয়সাধ্য ও সহজলভ্য। মূলত মানবসেবার উদ্দেশ্যে ডা.জাফরুল্লাহ গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল গড়ে তোলে ছিলেন। এখানে ন্যূনতম কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নেই। তিনি কখনো অন্যান্য ঔষধ কোম্পানির মতো মোটা অঙ্কের কমিশনের মাধ্যমে তাঁর কোম্পানির ঔষধ প্রেসক্রাইব করার জন্য চিকিৎসকদের বলতেন না। এই কারণে ডাক্তারাও বিনা কমিশনে গণস্ব্যস্থ্যের লিখতেন না এবং এখনো লিখেন না। তারপরও বাংলাদেশের বাজারে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালের উৎপাদিত ঔষধের যথেষ্ট সুনাম ও চাহিদা রয়েছে। কিন্তু চিকিৎসকদের অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের কারণে সাধারণ জনগণ গণস্বাস্থ্যের ঔষধ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে চিকিৎসকরা গণস্বাস্থ্যের ঔষধ প্রেসক্রাইব না করলেও কোনো ডাক্তার বা ঔষধ প্রশাসন এর কোয়ালিটির ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত কোনো প্রশ্ন তোলতে পারেনি।
গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জনগণকে স্বাস্থ্য সচেতন করার জন্য ওই সময় ডা. জাফরুল্লাহ `মাসিক গণস্বাস্থ্য` নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই পত্রিকা এখনো পর্যন্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে। আমাদের দেশে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই ধরনের পত্রিকা আজও বের করতে পারেনি বা বের করেনি। স্বাস্থ্য সেবার নামে অসৎ ও কপট ব্যবসায়ী ও চিকিৎসকদের কাছে মাসিক গণস্বাস্থ্য পত্রিকা আজও একটি মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে কাজ করছে। শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ডা. জাফরুল্লাহ ১৯৯৮ সালেদিকে সাভারে নিজস্ব জায়গায় প্রতিষ্ঠান করেন `গণ বিশ্ববিদ্যাল` ও `গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজ`। এই দুইটি প্রতিষ্ঠান সরকার কর্তৃক অনুমোধন প্রাপ্ত। আমাদের দেশের অন্যান্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের টিউশনি ফি অনেক কম এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও অনেক বেশি।
করোনাকালীন সময়ে এই দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষকরাই ড.বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে করোনা শনাক্ত করার কিট আবিস্কার করেছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে সেই কিট বাজারজাত করনের অনুমোধন পাওয়া যায়নি। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করোনার টেস্টের কিট আবিস্কার করতে পারেনি। আমাদের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে এই দু`টি প্রতিষ্ঠা কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। যেমন,গণ বিশ্ব বিদ্যালয় ও গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে এক সেমিস্টার গ্রামে গিয়ে থাকতে হয়, গ্রামের সহজ-সরল লোকদের সাথে মিশতে হয়, কৃষিকাজ জানতে হয় এবং একজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিতে হয়। এছাড়াও প্রতি বছর এই দু`টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ভাষা সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মননা ও উপহার দেওয়া হয়। এধরনের প্রক্রিয়া বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো পর্যন্ত চালু হয়নি।
গণস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠার পর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান জাতীয় ঔষধ নীতি প্রণয়ন। স্বাধীন বাংলাদেশের ঔষধের বাজারের প্রায় ৭০ শতাংশ ছিল ৮-১০ টি বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে; অপ্রয়োজনীয় ঔষধে বাজার পরিপূর্ণ ছিল। আর ৮৫ শতাংশ ঔষধই বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো; দেশীয় কোম্পানিরগুলির অবস্থা তেমন সুবিধাজনক ছিল না। বিদেশী কোম্পানিগুলির সাথে এরা তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছিল না। এমন ভয়াবহ অবস্থায় ১৯৮২ সালে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে নতুন জাতীয় ঔষধ নীতি বাস্তবায়ন করেন। এই সময় তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন-অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক মনিরুজ্জামন মিয়া, ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল, শাহাদৎ চৌধুরীসহ আরো অনেকে।
ওই সময় বহুজাতিক কোম্পানির পক্ষালম্বনকারী এবং ঔষধ নীতি বিরোধী চাকরিরত সরকারি-বেসরকারি ডাক্তারদের সংগঠন `বিএমএ` মাসিককাল ধর্মঘট করে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অচল করে দেবার পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ডা. জাফরুল্লাহ ও তাঁর সহযোদ্ধারা দৃঢ়ভাবে জাতীয় এই ঔষধ নীতি বাস্তবায়ন করেন। ডা. জাফরুল্লাহর এই ঔষধ নীতির বদৌলতেই তৎকালীন সময়ে ৪ হাজার ঔষধের মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৮০০ ঔষধ নিষিদ্ধ করা হয় এবং দ্রুত দেশীয় ঔষধ শিল্পের বিকাশ ঘটে। বর্তমানে দেশীয় ঔষধ কোম্পানিগুলো ২০ কোটি মানুষের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় দেড় শতাধিক দেশে ঔষধ রপ্তানি করছে। ঔষধ শিল্প আজ ৩৬ হাজার কোটি টাকার শিল্প!! বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আগের মতো আর একচেটিয়া দাপট নেই। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নতুন ঔষধ নীতির কারণেই বিশ্ব ঔষধবাজরে বাংলাদেশ এখন আমদানিকারক দেশ থেকে রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিকশিত হয়েছে!! কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশের ঔষধশিল্পের মালিকদের সংগঠন বা স্বাস্থ্য খাতের কোনো সংগঠন আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি তাঁদের কৃজ্ঞতা জানায়নি!! (চলবে)।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized