এই সমাজ ব্যবস্থায় পরিবার একটি প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠান। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পরিবারের বিকাশ। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সে একাকী বসবাস করতে পারে না। পারিবারিক বন্ধনের যে আবহ সেটা চিরন্তন ও শাশ্বত। একটি পরিবারে একটি শিশু যখন বড় হয়ে উঠে সেই পরিবারের ভালোবাসা ও স্নেহমমতার সম্পর্কটুকু সে চিরকাল হৃদয়ে ধারন করে। হউক সে একান্নবর্তী পরিবার বা একক পরিবার। একটি পরিবার মা-বাবা, ভাই-বোন, চাচা-চাচী, দাদা-দাদীদের নিয়ে গড়ে ওঠে। পরিবার হলো মানুষের সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের একটি রূপ এবং এই রূপকে বিশ্বজনীন রূপও বলা যেতে পারে। পৃথিবীতে পরিবারের অস্তিত্ব ও মানব সভ্যতার অস্তিত্ব ঠিক একই সমান্তরাল রেখায়। পরিবারের আছে নানান প্রকারভেদ। যেমন- পিতৃতান্ত্রিক পরিবার, মাতৃতান্ত্রিক পরিবার, একপত্মী পরিবার, বহুপত্মী পরিবার, একান্নবর্তী পরিবার ও একক পরিবার। জন্ম থেকেই আমাদের সাথে পরিবারের পরিচিতি। আবহমান বাংলার এই পরিবার প্রথা বেশ ঐতিহ্যের। বলা হয় একটি পরিবার হচ্ছে একটি শিশুর প্রথম পাঠশালা।
বস্তুত মানব সভ্যতার উত্থানই হয়েছে পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমে। এই বন্ধন গড়ে ওঠে স্নেহ-ভালোবাসা কিংবা শ্রদ্ধার নানা উপাদানে। আমাদের সমাজে আজও আত্মীয়তা বা বিভিন্ন সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে এই পারিবারিক ঐতিহ্যকে নানাভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়।
মানবজীবনে প্রত্যেক মানুষের জন্য পারিবারিক ঐতিহ্য ধারন করা ও বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা নেয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ । চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন করতে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। ভদ্রতা, নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা, কৃতজ্ঞতাবোধ শেখা, বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন, কনিষ্ঠদের স্নেহ-আদর করা, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, পরোকারিতার মানসিকতা গড়ে তোলা, উদার মানসিকতাবোধ জাগ্রত করা, সত্য কথা বলা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যতটা না অর্জন করা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিবার থেকে অর্জন করা যায়। সার্বিক বিবেচনায় পরিবারকে প্রেমপ্রীতি-ভালোবাসা ও মায়া-মমতায় ভরা একটি সুসজ্জিত বাগান বললেও অত্যক্তি হবে না। এই বাগানে প্রতিটি সদস্য তার চারিত্রিক গুণাবলি বিকশিত করার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। এর ভিত ও বাঁধন খুবই মজবুত। এই বাগান থেকে নৈতিক গুণাবলি সমৃদ্ধ হয়েই প্রতিটি সদস্য পরিপার্শ্বিক পরিবেশকে সুশোভিত ও মোহিত করে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকাল পরিবারের মধ্যে পারিবারিক বন্ধনের বড়ই ঘাটতি দেখা যাচ্ছে এবং এই সম্প্রীতির বন্ধন ব্যাপক হারে ভেঙ্গে যাচ্ছে। আর এই কারণেই আমাদের সমাজিক অস্থিরতা বেড়ে চলছে দিন দিন। আগে এক সময় একান্নবর্তী পরিবার ছিল যাতে, অসুবিধার তুলনায় সুবিধার দিকটাই ছিল বেশি। সকলেই বিপদে-আপদে পরস্পরের পাশে দাঁড়াতেন। ঈদ, পূজা, নববর্ষ ইত্যাদি উৎসব উদযাপন করতেন একসঙ্গে। পারিবারিক খাওয়াদাওয়া,হুইহুল্লোড়, বেড়ানো, চুটিয়ে গল্প করা-সব মিলিয়ে একটা জমমাট ব্যাপার ছিল। কিন্তু বর্তমানে ছবিটার ঠিক উল্টো।
এখন একদিকে যেমন একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছে । স্বার্থপরের মতো স্বামী-স্ত্রী তাদের মা-বাবাকে ছেড়ে আলাদা বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করছেন ; অপরদিকে একক পরিবারেও স্বামী-স্ত্রী একসাথে মিলেমিশে থাকতে পারছেন না। মতবিরোধ আর ইগোর লড়াই শেষ পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদে পরিণত হচ্ছে। ফলে বাড়ির বরকত পিতা-মাতার জায়গা হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে এবং পরিবারের সৌন্দর্য শিশুদের চাইল্ড কেয়ারে। এই অবস্থায় পরিবরিক পবিত্র বন্ধন অগ্নিপুরীতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
বাস্তবেই জীবনের সুখ-শান্তিতে বেঁচে থাকতে হলে পরিবারের সুনিবিড় ও দৃঢ় বন্ধন থাকা অবশ্যক। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, সুসঙ্গবদ্ধ পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনে বেঁচে থাকার আনন্দ যারা খুজে পান ও সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকেন, তারা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘায়ু হন এবং অন্যদের তুলনায় তাদের রোগব্যাধিও কম হয় ; এসব পরিবারের সদস্যরা সুস্থ জীবনযাপন করেন। তারা অত্যন্ত দায়িত্বশীল ও প্রতিভাবান হয়ে ওঠেন। আর পারিবারিক বন্ধন যাদের দুর্বল, যাদের পরিবার ভাঙ্গনের মুখে, তাদের সে ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটে থাকে। এককথায়-পারিবারিক সম্প্রীতির বন্ধনই মানুষের জীবনকে সুন্দর ও অর্থবহ করে তোলে।
বস্তুত, পারিবারিক সুদৃঢ় বন্ধন, সম্প্রীতি ও একত্মতা প্রতিটি পরিবারকে দেয় অনাবিল শান্তি ও সুন্দর জীবন। তাই আমাদের সকলের উচিত মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবার সাথে মিলেমিশে থাকা। কোনোভাবেই এই সম্পর্কগুলোকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। যে পরিবার নিয়ে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিনিয়ত পথ চলা সেই পরিবারে আমাদের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়। কিন্তু চ্যালেঞ্জে মোকাবেলায় আমরা যদি সকলেই পরমতম সহিষ্ণুতার পরিচয় দেই কিংবা পারস্পরিক বোঝাপড়াটা যদি শ্রদ্ধার আসনে অবিচল থাকে তাহলে কোনো বাধাই সেখানে বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে না। তবে আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া সব সময় অক্ষুন্ন রাখতে হবে। মানব সভ্যতার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সমাজে যে বিবর্তন ঘটেছে তা কিন্তু পারস্পরিক সহযোগিতারই ফসল।
খায়রুল আকরাম খান
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized