সেদিন হঠাৎ করেই পাকা লিচু গাছ থেকে পেরে খেতে উৎসাহী হয়ে উঠি। জাকির মাহদিন ভাই ও সাথে আরও দু’জনকে নিয়ে কাউতলি থেকে সিএনজি করে আখাউড়া বাইপাস হয়ে যাই খরমপুর। সিএনজি আমাদেরকে নিয়ে শোঁ শোঁ শব্দে ঝড়ের বেগে সামনের দিকে ছুটতে থাকে। অসংখ্য গাড়ি, গ্রাম-গঞ্জ পেছনে ফেলে অল্প সময়ে পৌছে যাই আখাউড়া বাইপাস। রোদ্দুরে গাড়ি থেকে নামি। কাঠফাটা রোদ। আমাদের কারুর মাথার উপর ছাতা নেই। দরদর করে ঘামি আর খড়মপুর মাজার শরিফ দেখতে হাটতে থাকি।
আমার ব্যক্তিগত পুরনো দিনের আহ্লাদ খড়মপুর মাজার দেখব। মাজারে পৌঁছে চকিত হয়! বিশাল বড় মাজার ও এর সংশ্লিষ্ট এরিয়া। পাশ দিয়ে একটি খাল তিতাস নদীতে গিয়ে মিলেছে। বর্ষা এলে উচ্ছল জলে টইটম্বুর হয়ে উঠে নদী। ফলে নৌকায় মানুষের যাতায়াত সুবিধা হয়। মাজারটি ২৬০ একর জমির উপর অবস্থিত। মাজারের খাদেম, মুরিদান দূরাগত অতিথিদের জন্য আলাদাভাবে থাকা ও আহার্যের ব্যবস্থা রয়েছে। গায়ে লাল পোশাক, লম্বা গোফ, মাথায় জটপাকানো চুল বিশিষ্ট লোকদেরকে দেখে বুঝাই যাচ্ছে – তারা মিথ্যাপীর সেজে জন-সাধারণকে আশীর্বাদ করে তাদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে। এদেরকে ইসলামের ভালোমন্দ দিকগুলো বুঝানো হয়েছে; কোনো কাজে আসেনি।এখন প্রয়োজন হল, দেশের সর্বত্র জটপাকানো পীরগুলোকে শক্ত হাতে দমন করা।
বলতে গেলে এখানে এসে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যান্বিত হয়েছি মূলমাজারের দুপাশে নারী ও পুরুষের নামাজের ব্যবস্থা দেখে। পুরুষেরা মাজারকে পিছনে রেখে পশ্চিম দিকে নামাজ পড়ছে, মহিলারা মাজারকে সামনে রেখে পশ্চিম দিকে নামাজ পড়ছে। বলা যায় মহিলাদের এই কাজ শিরকের নামন্তর। আসুন মাজারের ইতিহাস জেনে নেই:১৩০৩ সালে হযরত শাহজালাল (র.) ইসলাম প্রচারের জন্য ৩৬০ জন আউলিয়া নিয়ে এসেছিলেন সিলেটে। এই ৩৬০ জন শিষ্যের মাঝে অন্যতম ছিলেন সৈয়দ আহমদ গেছুদারাজ কল্লা শহীদ (র.)। তিনি হযরত শাহজালাল (র.) খুব কাছের লোক ছিলেন।
খড়মপুর মাজার শরীফ সম্পর্কে কাহিনি প্রচলিত আছে সেটা হল, সে সময় খড়মপুর গ্রামের জেলেরা তিতাস নদীতে মাছ ধরত। একদিন চৈতন্য দাস ও তার সঙ্গীরা তিতাস নদীতে মাছ ধরার সময় হঠাৎ তাদের জালে একটি খণ্ডিত মস্তক আটকা পড়ে। বিষয়টি দেখে জেলেরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। খণ্ডিত মস্তকটি উঠাতে গেলে আল্লাহর কুদরতে খণ্ডিত মস্তকটি বলে ওঠে, “একজন আস্তিকের সাথে আর একজন নাস্তিকের কখনো মিল হতে পারে না। তোমরা যে পর্যন্ত কলেমা পাঠ করে মুসলমান না হবে ততক্ষণ আমার মস্তক স্পর্শ করবে না।” খণ্ডিত মস্তকের কাছ থেকে এই কথা শোনার পর চৈতন্য দাস ও তার সাথীরা হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। খণ্ডিত মস্তকের নির্দেশ অনুযায়ী ইসলামি মতে খণ্ডিত মস্তকটি দাফন করে এবং তারা মাজারটির খাদেমদারিতে নিযুক্ত হন।
এটি নিয়ে একথাও প্রমাণিত আছে যে, তরফ রাজ্যেও রাজা আচক নারায়ণের সঙ্গে হজরত শাহজালালের প্রধান সেনাপতি হযরত সৈয়দ নাসিরউদ্দিন (র) যে যুদ্ধ পরিচালনা করেন সে যুদ্ধে হযরত সৈয়দ আহমদ গেছুদারাজ (র.) শহিদ হন এবং তার খণ্ডিত মস্তক তিতাসের স্রোতে ভেসে আসে।প্রতি বছর মাজারটিতে ওরস উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। মাজারের চারপাশ ঘুরাঘুরি শেষে সুখপানীয় ধোয়া উঠা চা পানে বড্ড মেতে উঠি। সময় ততক্ষণে দুপুর বারোটা। তড়িঘরি ঘাড়িতে উঠে আজমপুর রেলস্টেশনে পৌঁছাই সিলেটের রেলপথ দেখতে। খুব-ই সরু রেল পথ। শুধু একটা ট্রেন যাওয়া-আসার মতো লোহার দুইটা পাত বিছানো লম্বা রাস্তা। চোখে পড়ে এখানকার গ্রামে মাটির ঘর। আশপাশের ঘর-বাড়ি ও ফাঁকা ফাঁকা। অনেকটা নির্জন পরিবেশ। দেখে বরাবরের মতো মুগ্ধ হই।
এখানে বেশি দেরি না করে জুমার নামজ পড়ি আমোদাবাদ বাইতুল ফালাহ জামে মসজিদে। দুপুরের খাবার সম্পন্ন করি শিঙ্গারবিল বাজারের এক রেস্তোরায়। লিচু খাওয়ার ইচ্ছাটা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠে। আবারো চারজন বসার মতো একটা অটো ভাড়া করি। মিরাশানি হয়ে বিষ্ণুপুর বিডিআর ক্যাম্পের (ভারত বাংলাদেশের সীমান্ত) সামনে গিয়ে অটো অনেকটা থেমে থেমে চলতে শুরু করে। আমরা অপলক বিস্ময়ের চোখে সীমান্তবর্তী গাছ-পালার দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকি।
অতিশয় লম্বা লম্বা গাছ যেন আকাশ ছুঁয়েছে। একটা শতবর্ষী কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখে খুবই মুগ্ধ হয়েছি। পাহাড়ি ডাল, অনেকটা সাপের মতো আঁকাবাঁকা রাস্তা ঘুরতে ঘুরতে লিচুর রাজ্য ‘পাকাবাড়ি’ এসে অটো আমাদেরকে নামতে ইঙ্গিত করে। কী যে অপরুপ! স্বর্গীয় উদ্যানের মতো লিচু গাছের বাগান। লালচে, রক্তিম লিচু দেখতে অসম্ভব সুন্দর। বেশ পরিপক্ক। বাগানের প্রহরীদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম বৃষ্টির অভাবে লিচু এখনো পরিপূর্ণ মিষ্টি হয়নি। এর মাঝে লিচু অনেক বিক্রিও হচ্ছে। বৃষ্টি হলে নাকি লিচুতে মিষ্টতা আসে।
গ্রামের কোথাও কোথাও বাঁশঝাড় ও দেখেছি।প্রাকৃতিক দৃশ্য। বুনো বাঁশের মতন বিশাল লম্বা লম্বা। সবশেষে মহেশপুর জাকির মাহদিন ভাইয়ের খালার বাড়িতে উঠি। তার খালুর একটা লিচুর বাগানে ফলন হয়েছে ভালো। আমাদেরকে লিচু গাছ থেকে পেরে খেতে তাগাদা করেন খালু। আমরা লালচে, পুষ্ট, ডাগর ডাগর লিচু পেরে খেয়ে তৃপ্ত হই। গাছ থেকে পেরে খাওয়ার স্বাদই আলাদা। পরক্ষণে সিএনজিতে চড়ে চম্পকনগর বাজার হয়ে শেখ হাসিনা রাস্তাযোগে বাহ্মণবাড়িয়া সদর।
লেখক: আমানুল্লাহ মুর্তজা
শিক্ষক ও শিক্ষানবিশ সংবাদকর্মী
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized