রেলপথে ভ্রমণ খুবই আরামদায়ক। দেশের অন্যান্য পরিবহনের মতো রেলভ্রমণেও টিকিট কাটতে হয়। তবে রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বিনা পয়সায় টিকিটের পরিবর্তে পাস এর ব্যবস্থা রয়েছে। এই পাসকার্ড দ্বারা রেলওয়ে কর্মচারীরা ট্রেনে দেশের যে কোনো অঞ্চলে ভ্রমণ করতে পারেন। টিকেট কাটার ক্ষেত্রে কেউ যদি এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভ্রমণ করেন, তা হলে তাকে জরিমানাসহ হাজতবাসও করতে হয়! কিন্তু দেশের অন্যান্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এমনটি হয় না। শুধু গন্তব্যস্থলের ভাড়া পরিশোধ করলেই চলে।
বাংলাদেশ রেলের আইন অনুযায়ী, বিনা টিকিটে ধরা পড়লেই ২৫০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। জরিমানার টাকা নির্ধারণ করা হয় যাত্রাস্থল থেকে শেষ গন্তব্য পর্যন্ত! এটা এক ধরনের অমানবিক নিয়ম। এছাড়াও ইদানিংকার রেলের আইনে নিজের নামে কাটা ট্রেনের টিকিট কারো কাছে বিক্রি বা হস্তান্তর করলে তিন মাস পর্যন্ত জেল বা জরিমানা হতে পারে। এতো কঠোর আইন থাকার পরও কিছু কিছু লোক আমলা-মন্ত্রী-এমপি, রাজনীতিবিদ-রেলকর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আত্মীয় পরিচয়ে দিব্যি আরামে বিনা টিকিটে রেলভ্রমণ করছেন! তারা এটাও জানেন, চেকারের নিকট বিনা টিকেটে ধরা পরলে ট্রেনের কয়েক গুণ জরিমানা হিসাবে দিতে হবে। এটা আমাদের দেশের নিত্যদিনকার ঘটনা। এটা একধরনের লজ্জাজনক ঘটনাও বটে। আর এমনই এক লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়ের ক্ষেত্রে।
সেই নির্লজ্জ ঘটনাটি হলো-গত ৫ মে রাতে পাবনার ঈশ্বরদী জংশনে তিন যাত্রী টিকিট না কেটেই ঢাকাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে এসি কেবিনে চেপে বসেন। ট্রেনের কর্তব্যরত ভ্রাম্যমাণ টিকিট চেকার (টিটিই) মো. শফিকুল ইসলাম টিকিট দেখতে চাইলে তাঁরা রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেন। তখন টিটিই ওই তিন যাত্রীকে এসি টিকিটের পরিবর্তে মোট ১ হাজার ৫০ টাকা নিয়ে জরিমানাসহ সুলভ শ্রেণির নন-এসি কোচে সাধারণ আসনের টিকিট করে দেন। ব্যস, ঘটনা এতো টুকুই। কিন্তু ওই তিন যাত্রী সাধারণ এই ঘটনাটিকে তিলকে তাল বানিয়ে জটিলতার সৃষ্টি করলো। রেলমন্ত্রীর আত্মীয় বলে কথা। অভিজাত শ্রেণির লোক। ছেড়ে দেবে সামান্য বেতনে চাকুরে টিটিইকে, তা কি কখনো হয়! ইজ্জত বলে কথা। মোটেই তা নয়। ইজ্জত রক্ষার মানসে ওই তিন যাত্রী তাৎক্ষণিকভাবে ট্রেনে লিখিত কোনো অভিযোগ না করে ঢাকায় পৌঁছেই টিটিই শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে `অসতাচরণ` অভিযোগ করে বসলেন।
পরদিন কর্তব্যরত অবস্থাতেই শফিকুল ইসলোমের কাছে ফোন আসে রেলমন্ত্রীর আত্মীয়দের সঙ্গে `অসদাচরণ` করার অভিযোগে তাঁকে সাময়িকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আর তাঁকে বরখাস্তের আদেশ দেন পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন।
এরপর যা যা ঘটে, তা চরম নাটকীয়তায় ভরা। রেলমন্ত্রী প্রথমে এই ঘটনার সঙ্গে আত্মীয়স্বজননের সস্পৃক্ততার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। পরে আবার স্বীকার করেন যে বিনা টিকিটের যাত্রীরা তাঁর স্ত্রীর দিক থেকে আত্মীয় হলেও তিনি তা জানতেন না।
এই তিন যাত্রীর অভিযোগের প্রেক্ষিতেই রেলমন্ত্রীর স্ত্রী একজন ঊধ্বর্তন রেল কর্মকর্তার কাছে টিটিইর বিরুদ্ধে নালিশ করেন। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া তাঁর নালিশেই টিটিইকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার বিষয়টি বেশ বিস্ময়কর ব্যাপার বটে! সম্মানিত মন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ করে ওই আত্মীয়রা অপরাধ করেছেন। এই অপরাধের সঠিক বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু এখন মন্ত্রী তাঁদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেন তা দেখার বিষয়।ইতিমধ্যে মন্ত্রী তাঁর স্ত্রীর এহেন আচরণে বিব্রত বোধ করে বলেছেন, তাঁর স্ত্রী তাঁকে না জানিয়ে সরাসরি রেলওয়ের কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়ে ঠিক কাজ করেননি। মন্ত্রীর এই স্বীকারোক্তি স্বস্তিদায়ক। তবে এটা বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশে সাধারণ কোনো নাগরিকের কোনো একটি অভিযোগের জেরে বিশেষ করে একজন সরকারি কর্মচারীকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাস্তির আওতায় আনার ঘটনা একেবারেই বিরল!
ইতিমধ্যে ৮ মে টিটিইর বরখাস্তের আদে শ প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে পাকশী বিভাগীয় সহকারী রেল পরিবহন কর্মকর্তা সাজেদুল ইসলামকে। গঠিত তদন্ত কমিটিকে দুই কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটাও একটি ইতিবাচক ঘটনা। তারপরও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়।
গত ১৬ মে তদন্ত কমিটি তাদের রির্পোট প্রকাশ করেছে। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ঘটনার জন্য দায়ী ওই ট্রেনের পরিচালক(গার্ড) শরিফুল ইসলাম। টিটিইর সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধের কারণে তিনি রেলমন্ত্রীর `কথিত` আত্মীয় ইমরুল কায়েস প্রান্তকে প্ররোচনা দিয়ে টিটিই সফিকুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করিয়েছিলেন। তদন্ত প্রতিবেদনে গার্ড শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। আর মিথ্যা অভিযোগ করায় ইমরুল কায়েসকে গণমাধ্যমের সামনে এসে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে। তবে রেলমন্ত্রীর অপর দুই আত্মীয়ের বিষয়ে বলা হয়েছে, তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক। এ জন্য তদন্তে তাদের অন্তভুর্ক্ত করা হয়নি। এদের একজনের নাম ওমর ও অপরজনের নাম হাসান। এরা রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মি আক্তারের মামাতো ভাই ও ইমরুল কায়েস ভাগনে। এরা ঈশ্বরদী শহরের নূর মহল্লা এলকার বাসিন্দা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এতো দ্রুত সময়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদ প্রকাশ এবং কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, দোষীকে শাস্তি প্রদান দুর্লভ ঘটনা!
মূলত রেলআইন ভঙ্গ করে বিনা টিকিটে গাড়ি চড়ে অপরাধ করেছে মন্ত্রীর ওই তিন আত্মীয়, অথচ ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে টিটিইকে ফাঁসাতে গিয়ে ফেঁসে গেলেন গার্ড। তারপরও বলবো, বিনা টিকিটে রেলভ্রমণ করার কারণে ধরা পড়ায় লজ্জা হওয়ার কথা মন্ত্রীর তিন আত্মীয়ের। কিন্তু অন্যায়ের অনুশোচনার লজ্জাবোধ মনে হয় তাঁদের মধ্যে ছিল না। নিলজ্জের মতো ঢাকায় পৌঁছেই নিজেদের বাহাদুরী জাহির করার জন্য রেলের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের নিকট টিটিইর বিরুদ্ধে মিথ্যা `অসদারণ` করার অভিযোগ আনেন তারা। তবে একথা বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, রেলের বেশিরভাগর টিকিট কাউন্টারকর্মী, নিরাপত্তাকর্মী, স্টেশনমাস্টার, গার্ড, টিকেট চেকার, অ্যান্টেডেন্স, ড্রাইবার আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। তাদের কাছে রেলের যাত্রীরা কোনো অনিয়মের প্রতিকার চাইতে গেলে অভদ্র আচরণ করেন। তাঁরা বিনা টিকিটে যাত্রীদের প্রতি বেশ যত্নবান হন এবং উৎকোচের মাধ্যমে তাঁদেরকে আরামদায়ক ছিটের ব্যবস্থা করে দেন। তাদের এধরনের অসৌজন্যমূলক আচরণের কারনেই কিছু কিছু যাত্রী ট্রেনে বিনা টিকিটে যেতে বেশ উৎসাহিত হন। হয়তো মন্ত্রীর ওই তিন আত্মীয় এই সুযোগটিই গ্রহন করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাঁরা একাজে সফল হননি।
আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত এমন অনেক ঘটনা অহরহ ঘটছে। মন্ত্রী-এমপি, আমলা-রাজনীতিবিদ বা প্রভাবশালী কারও নাম ভাঙিয়ে অনেকেই হয়তো নিজেদের ফায়দা লুটে নিচ্ছে। সেই রাজনীতিবিদ-আমলা হয়তো অনেক সময় জানেনই না যে, তাঁর নাম ভেঙে বেচাকেনা চলছে। আবার অনেক প্রভাবশালী হয়তো ইচ্ছা করেই তাঁর অনুসারীদের নিজের নাম ভাঙানোর সুযোগ দিয়ে থাকেন। এহেন চর্চা যেন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতির বিশেষ অংশ হয়ে যাচ্ছে। তবে এধরনের গর্হিতকাজ কোনোভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized