যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশ মুক্তকারাগারে বসবাস করছে। অভিশপ্ত এই ইহুদি জাতি ফিলিস্তিনের বুকে অবৈধভাবে ইজরাইল নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে খুন-গুম-ধষর্ণসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে আরব মুসলিমদেরকে তাদের পৈত্রিকভূমি থেকে বিতারীত করে তা দখল করা অব্যাহত রেখেছে। নিয়তীর নিমর্ম পরিহাস আশ্রয়দাতা হয়ে যায় আশ্রয়হীন আর আশ্রয়ীরা বনে যায় দখলদার! আজ দখলদারের হিংস্র আচরণে ভূলুন্ঠিত হচ্ছে মানবতা।
ধরনির বুকে এই দখলদার ইহুদি জাতির শুরুটা হয়েছিল মহিমান্বিত মানুষের হাত ধরেই। তারা আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত হযরত ইব্রাহিম(আ.)-এর দৌহিত্র হযরত ইয়াকুব(আ.)-এর বংশধর। হযরত ইয়াকুব(আ.)-এর এক পুত্রের নাম ছিল ইয়াহুদা। সেই নামের অংশবিশেষ থেকেই ইহুদি নামে উৎপত্তি। আর বংশেই ইহুদি ধর্মের প্রবক্তা হযরত মুসা (আ.) জন্মগ্রহন করেছিলেন। তবে হযরত ইয়াকুব(আ.)-এর পুত্র ইউসুফ(আ.)-কে হত্যার প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইহুদিদের সাদা দেয়ালে কালো দাগ লাগে। হিংসা ও ষড়যন্ত্রের শুরু সেখান থেকেই। অবাধ্যতা ও বিশ্বাসঘাতকতা রয়েছে তাদের রন্ধে রন্ধে। জাতি হিসেবে ইহুদিদের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও অপকর্মের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। পবিত্র কোরআনে ইহুদিদেরকে অভিশপ্ত ও লাঞ্ছিত জাতি হিসেবে চিহিৃত করা হয়েছে। সুদখোর ও ধনলিপ্সু জাতি হিসেবেও তাদের একটি পরিচয় রয়েছে। এ জাতি যুগ যুগ ধরে খোদাদ্রোহীতা, কুফরি ও তাদের খারাপ কর্মকান্ডের জন্য মানুষের কাছে অত্যন্ত ঘৃনাভাবে পরিচিত পেয়ে এসেছে।
জন্মগতভাবেই এই জাতি খু্বই চতুর ও ধুরন্ধর হওয়ায় বিভিন্ন ছলচাতুরী দিয়ে মানুষকে বশীভূত রাখার কৌশল অবলম্বন করে। এর মাধ্যমে তারা অন্যের ওপর দিয়ে যুগে যুগে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সেই প্রাচীনকাল থেকে ইহুদিরা যেই জনপদে গিয়েছে সেই জনপদের সাধারণ মানুষকে অন্যায় ও খোদাদ্রোহীতা কাজে উৎসাহিত করেছে। তারা নবী-রাসূল-ধর্মগুরু ও শাসকদের আদেশ অমান্য করেছে, বিদ্রোহ করেছে। এমনকি অনেক সময় তাদেরকে হত্যাও করেছে!! তাদের এসব গহির্তকর কাজের জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে অনেক সময় কিছু কিছু রাজা-বাদশারা তাদেরকে কঠোরভাবে দমনও করছে। আবার অনেককে প্রয়োজনে হত্যাও করেছেন। তারপরও তারা দমেনি! আজও তারা বিশ্বব্যাপী তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
বস্তুত, নানা অপকর্ম ও খোদাদ্রোহীতামূলক কাজের কারণে খোদায়ীগজব হিসেবে ইহুদি জাতির বিনাশ শুরু হয় ব্যাবীলনের রাজা নেবুচাদনেজারের আমলে। তবে দাউদ-(আ.)-এর গোত্রের পরবর্তী দুর্বল শাসকদের অদক্ষতা এই বিনাশকে আরো ত্বরান্বিত করে তোলে। গবেষবদের মতে, ইহুদি জাতির প্রতাপশালী বাদশা সুলতান সুলায়মান(আ.)-এর মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র রাহবায়াম খ্রিস্টপূর্ব ৯৩১ অব্দে কেনানের সিংহাসনে বসেন। তখন ইহুদিরা ১২ টি গোত্রে বিভক্ত ছিল। এদের মধ্যে ১০ টি গোত্রই সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। বিদ্রোহীরা কেনান অথার্ৎ ফিলিস্তিনের উত্তর ও মধ্য অঞ্চলে সামারিয়া (ইজরাইল) নামে নতুন রাজ্য গড়ে তোলেন। এইদিকে সুলতান রাহবায়াম জুডা ও বেঞ্জামিন গোত্র দুটোকে নিয়ে ফিলিস্তিনের দক্ষিণ অঞ্চলে জুডা রাজ্য গড়ে তোলেন। তখন পবিত্র শহর জেরুজালেম তার দখলেই থাকে। ওই সময়ে প্রায়ই ইজরাইল ও জুডা রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ লেগে থাকতো। মহান সৃষ্টিকর্তর অভিশাপে এই ভাবে ইহুদি জাতি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। এই সুযোগে খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দে মেসোপটেমিয়ার দুর্ধষ রাজা নেবুচাদনেজার দাউদ(আ.)-এর বংশের শেষ শাসক সুলতান সেদেকিয়াকে পরাজীত করে জুডা রাজ্য দখল করে নেয়। এই আক্রমনে জুডা রাজ্য ধ্বংস হয়ে ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এই আক্রমন কালে আল আকসাকে লুন্ঠন করার পর ধ্বংস করা হয়। হাজার হাজার লোকদের হত্যা করা হয়। অতঃপর ইহুদি রাজন্যবর্গ, যাজক ও গণ্যমাণ্য লোকদের বন্দি করে ব্যাবিলনে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ বছর ইহুদিরা ব্যাবিলনে বন্দি ছিল। এই ঘটনাটি “ব্যাবিলনীয় বন্দিদশা” নামে পরিচিত। নেবুচাদনেজারের হাতে বন্দি হয়ে ইহুদিরা স্বাধীন রাজ্য হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পরে। শুরু হয় তাাদের জীবনের ভয়ংকর এক নতুন অধ্যায়।
এইদিকে রাজা নেবুচাদনেজারের মৃত্যুর প্রায় ২০ বছর পর পারস্য সম্রাট সাইরাস খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে ব্যাবিলনীয়দেরকে পরাজিত করে মেসোপটেমিয়া অঞ্চল জয় করেন এবং ব্যাবিলনীয় সাস্রাজ্য পারস্যের দখলে চলে যায়। এই সময় রাজা সাইরাস “ব্যাবিলনীয় বন্দিদশা” থেকে ইহুদিদের মুক্ত করেন ও ফিলিস্তিন অঞ্চলে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন। অতঃপর ইহুদিরা পারস্যের আনুগত্য স্বীকার ফিলিস্তিন অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে ইহুদিরা আবারও পদভ্রষ্ট হয়ে যায়। তারা পারস্য সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। অকৃজ্ঞ ইহুদিদের এহেন আচরণে অতিষ্ট হয়ে পারস্য সম্রাট দারিয়ুস খ্রিস্টপূর্ব ৫১৬ অব্দে ফিলিস্তিন আক্রমন করে প্রচুর ইহুদিকে হত্যা করেন এবং অনেককে নির্বাসনে পাঠান। এইদিকে সৃযোগ বোঝে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ অব্দে গ্রিকবীর আলেকজান্ডার পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুসকে পরাজিত করে গোটা পারস্য সাম্রাজ্যে গ্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে সমগ্র ফিলিস্তিন গ্রিক শাসনাধীনে চলে আসে। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে আলেকজান্ডরের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর সেনাপতি টলেমি ফিলিস্তিনসহ মিশরের ক্ষমতা নেন। অন্যদিকে সেনাপতি সেলুকিড দায়িত্ব নেন সিরিয়া থেকে ব্যাকট্রিয়া প্রদেশ পর্যন্ত।
প্রথমদিকে ইহুদিদের সাথে গ্রিকদের সম্পর্ক ভালো ছিল। নেতৃত্বের কোন্দল নিয়ে কলহপ্রিয় ইহুদিরা হেলেনিক ও ফারিসি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পরে। সেলুকিড সম্রাট ৪র্থ এন্টিয়োকাস হেলেনিক গোষ্ঠী থেকে জেরুজালেমের প্রধান আরাধনা গৃহ পরিচালনার জন্য একজন যাজক নির্বাচিত করেন, কিন্তু ফারিসি গোষ্ঠীর লোকেরা তাকে মন্দির থেকে বের করে দেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে রাজা রাগান্বিত হয়ে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে ফিলিস্তিন রাজ্যে ইহুদি ধর্ম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তার নির্দেশে উপাসনালয়টি লুন্ঠন করা হয়। এসময় অনেক ইহুদি গ্রিকসেনাদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।
এই নির্যাতনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য খ্রিস্টপূর্ব ১৬৬ অব্দে ফিলিস্তিনের দক্ষিণ অঞ্চলের ইহুদিরা “মাথাথিয়াস” নামে এক যাজকের নেতৃত্বে সেলুকিট সম্রাট ৪র্থ এন্টিয়োকাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ইতিহাসে এটি “মাকাবি বিদ্রোহ” নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের কারণে পুরো ফিলিস্তিন এলাকা অশান্ত হয়ে উঠে। এই বিদ্রোহ দীর্ঘ দিন যাবৎ চলে। ফলে ফিলিস্তিন রাজ্য দুর্বল হতে থাকে। এই সুযোগে খ্রিস্টপূর্ব ৬৪ অব্দে বিখ্যাত রোমান সেনাধ্যক্ষ নিয়াস পাম্পেয়াস ম্যাগনাথ ফিলিস্তিন আক্রমন করে উগ্রবাদী ইহুদিদেরকে পরাজিত করে ফিলিস্তিনসহ সমগ্র সিরিয়াকে রোমান সাস্রাজ্যের একটি করদরাজ্যে পরিণত করেন। এই অভিযানের সময় রোমান সেনাদের হাতে জেরুজালেম শহরের পতন হয় এবং প্রায় বার হাজার ইহুদি নিহত হয় ও সমপরিমান ইহুদিকে বন্দি করে দাস বানিয়ে সাম্রাজ্যের অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর হাজারো ইহুদি পালিয়ে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশসমূহে আশ্রয় নেয়। শুরু হয় ইহুদিদের লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার যাযাবর জীবন।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized