মসজিদকে বলা হয় আল্লাহর ঘর। মসজিদের আভিধানিক অর্থ সিজদার জায়গা। খোলা প্রাঙ্গন, গম্বুজ ও উঁচু মিনার বিশিষ্ট মসজিদ সমাজ ও সংস্কৃতিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। সেই সুলতানী আমল থেকে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বাংলায় অসংখ্য মসজিদ স্থাপিত হয়েছে এবং ইসলাম প্রচারসহ মানবিক ও নৈতিক সমাজ গঠনে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে মসজিদের পূর্বেকার গৌরবজনক ভূমিকা হ্রাস পেতে থাকে। বর্তমানে আমাদের দেশের সর্বত্র নৈরাজ্য ও অস্থিরতা চলছে। সুতরাং বর্তমান এই অবস্থাকে বিবেচনায় রেখে সমাজ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে কার্যকরভাবে মসজিদকেন্দ্রিক কিছু কার্যক্রম পরিচালানা করা সম্ভব। এখানে এসব পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ সম্পর্কে অতি সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করা হলো। আর এসব কাজের লক্ষ্য মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
ইসলামের আনুষ্ঠানিক ইবাদতের মূল কেন্দ্র হলো মসজিদ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুম্মার নামাজ, বিশেষ ক্ষেত্রে ঈদের দুই নামাজ, রমজানের তারাবির নামাজ ও কুরবানিসহ যাবতীয় ইবাদত ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। সুতরাং এসব ইবাদতের পাশাপাশি ইসলামের দাওয়াত, সমজাকল্যান ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডও একটি মসজিদে একজন ইমামের নেতৃত্বে হতে হবে। সুতরাং ইমমাকে হতে হবে জ্ঞানী, সাহসী ও ইনসাফকারী। তোষামোদকরী ইমাম সব সময় বর্জনীয়। মসজিদ কমিটি পরিচালিত হবে ইমামের নেতৃত্বে, কোনো সভাপতি বা সেক্রেটারীর নেতৃত্বে নয়। তবে এ-ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন ইমামের জন্য অবশ্যই সম্মানজনক সম্মানীর ব্যবস্থা করতে হবে।
মসজিদকেন্দ্রিক সমাজ বিনিমার্ণের জন্য প্রথমে সৎ, ধার্মীক, নিষ্ঠবান ও উদ্যমী ব্যক্তিবর্গ নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। কোনো সুদখোর, কালবাজারী, জুয়াড়ী ও লাঠিয়াল এই কমিটির সদস্য হতে পারবে না। এই কমিটিকে সব ধরনের দলীয় রাজনীতিকে বর্জন করে শুধুমাত্র দ্বীনি কাজ হিসেবে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হয়ে যথাযথভাবে কাজ করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা, প্রয়োজনীয় অর্থ ও মতৈক্য।
মসজিদ নিমার্ণ একটি পূর্ণময় কাজ আর এর সওয়াব মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে। কিন্তু শর্ত হলো, এতে কোনো রকমের অহমিকা, গৌরবের বিষয় মনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। জবরদখল করে বা সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গায় বা কাউকে ফুসলিয়ে-ফাসলিয়ে বা ভয়-ভীতি দেখিয়ে কোনো জায়গায় মসজিদ তৈরি করা যাবে না। মসজিদ নিমার্ণের জন্য স্বেচ্ছায় ভূমিদান করতে হবে। মসজিদ নিমার্ণ করতে হবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়।
মসজিদ মুসলমাদের একটি পবিত্র স্থান। এটাকে সব সময় কোলাহলমুক্ত, পরিস্কার-পরিছন্ন ও সুগন্ধিময় করে রাখতে হবে। অন্যের ইবাদত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো অনর্থক ও অয়োজনীয় কথা বলা মসজিদে থাকা অবস্থায় সব সময় পরিহার করতে হবে। মসজিদে কারো জন্য কোনো জায়গা বরাদ্দ রাখা যাবে না বা কাউকে ডিঙ্গিয়ে সামনে যাওয়া যাবে না, এখানে সবাই সমান। মসজিদের ভিতর ও বাইরে ভিন্নমত-দর্শন ও অমুসলিমকে তিরস্কার-উপহাস করে কোনো ধরনের বক্তব্য দেওয়া যাবে না। এতে দাঙ্গা-ফাসাদ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
সুলতানী আমল থেকে মুগল আমল পযর্ন্ত বাংলার প্রতিটি জামে মসজিদে লঙ্গরখানাসহ মুসাফিরের রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা থাকতো। তাই মসজিদের গেইট কখনো বন্ধ হতো না। ক্লান্ত পথিকরা মসজিদের ওজুখানায় গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ও পানি পান করে বেশ কিছুক্ষন বিশ্রাম নিতো। আবার অনেক সময় প্রাকৃতিককাজও সম্পন্ন করতো। সুতরাং মানবসেবার বৃহৎ স্বার্থে আমাদেরকেও পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে হবে। তবে বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে ২৪ ঘণ্টা না হলেও জামে মসজিদগুলো ভোর ৫ টা থেকে রাত ১২ টা পযর্ন্ত খোলা রাখা যেতে পারে। এতে মুসাফিরদের মসজিদে রাত্রি যাপনের সুবিধা হবে এবং যেকোনো লোক সহজে মসজিদের টয়লেট ও ওজু্রখানা ব্যবহার করতে পারবে।
খুতবা ব্যতীত জুমার নামাজ হয় না। উপস্থিত মুসল্লিদের জন্য খুতবা শোনা ওয়াজিব। তাই খুতবা চলাকালে জাগতিক সব কাজ বন্ধ রাখতে হবে। তবে পরিবেশ, পরিস্থিতি ও সময়ের আলোকে জুমার খুতবার বিষয়বস্তু নির্ধারন করতে হবে, যাতে মুসল্লিরা খুতবার বিষয়বস্তু বুঝে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হয় এবং মুসলমানদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ এর পরিবর্তে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন রচিত হয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে সোনালী যুগ পর্যন্ত জুমার খুতবা এমন ভূমিকাই পালন করেছে
পৃথিবীব্যাপী সকল মুসলিমকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। এখানে পরস্পর থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। তবে কোনো বিষয় নিয়ে মুসল্লিদের মধ্যে কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব্-মতানৈক্য দেখা দিলে সেগুলো মসজিদ কমিটির মাধ্যমে সংশোধন করে নিতে হবে। পাড়া-মহল্লার মধ্যে কোনো ধরনের কলহের সৃষ্টি হলে সমাজে শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য মসজিদে বিচার-ফয়সালা করা যেতে পারে। এছাড়ও কোনো পরিবারের মধ্যে দাম্পত্য কলহ দেখা দিলে মসজিদে কাউন্সিলিং করা যেতে পারে।
সমাজ থেকে অভাব-অনটন দূর করার লক্ষ্যে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে যাকাত ও সদকাহর অর্থ সংগ্রহ করে মসজিদের তত্বাবধানে অসহায়-গরীবদের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বন্টন করা যেতে পারে। এছাড়াও সমাজের যেকেউ যেকোনো সময় বিপদগ্রস্ত হলে তাকে সহযোগিতা করার জন্য অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে একটি বিশেষ ফান্ড গঠন করা যেতে পারে।
আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায়ই ঘটে থাকে। সমাজের কিছু মানুষ ত্রাণ বিতরনের মানসিকতা পোষণ করলেও কোনো উদ্যোগ না থাকায় তার ইচ্ছা বাস্তবায়ন হয় না। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মসজিদের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরন প্রকল্প গ্রহন করে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরন করা যেতে পারে।
সমাজ থেকে জুয়া, মাদক, চুরি, ডাকাতি, কালবাজারী, খুন, গুম, ছিনতাই, রাহজানীসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ দূর করার লক্ষ্যে মাদকাসক্ত ও অপরাধ কর্মে জড়িতদের সাথে মসজিদে আন্তরিকভাবে কাউন্সিলিং করা যেতে পারে। এছাড়া অল্প খরচে মসজিদে বিয়েশাদির ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।
মসজিদের সামাজিক কর্মকান্ডের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হলো চিকিৎসা সেবা। সমাজের গরীব লোকেরা যাতে সহজে অসুস্থতার প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিতে পারে, সেজন্য মসজিদ কতৃর্ক চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষ ঔষধ ও উন্নত চিকিৎসার উদ্যোগও গ্রহণ করা যেতে পারে।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরস্পর সম্পর্কিত বিষয়। উন্নত শিক্ষার বিনিময়ে উন্নত সংস্কৃতির সোপান তৈরি হয়। এ লক্ষ্যে মসজিদ প্রশস্ত ও বহু সুবিধাসমৃদ্ধ হতে হবে। কুরআন, হাদিস, ইতিহাস, দর্শন ও ইসলামিক বইপত্র নিয়ে ভালো মানের পাঠাগার মসজিদে স্থাপন করতে হবে। ফজর থেকে এশা পর্যন্ত পাঠকের সেখানে বইপত্র পড়ার সুযোগ থাকবে। ( চলবে)।
খায়রুল আকরাম খান
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized