দেশে মূলত ২০১৪ সালের পর থেকে জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়া কোনো সরকার ক্ষমতায় ছিলো না। প্রতিবেশী দেশ ইন্ডিয়ার প্রত্যক্ষ মদদ ও ইন্ধনে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নির্বাচনের নামে তামাশা করে আওয়ামী লীগ সরকার জবরদস্তি মূলক ক্ষমতা দখল করে রেখেছিলো।
মুক্ত ভাবে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ দূরের কথা মানুষের কথা বলার অধিকার ছিলো না। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী কুক্ষিগত করে রাখার জন্য ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট জারি করে মানুষের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিলো।
কথায় কথায় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের আটক করে সাজানো মামলা দিয়ে জেলে আটক করে রাখা ছিলো নিত্যদিনের ঘটনা। দেশে ভীতিকর পরিস্থিতি কায়েম করা হয়েছিলো। মানুষের মুখে কোনো আওয়াজ ছিলো না। তারা চুপে চুপে শুধু বলতো এ জালিমের হাত থেকে আমরা কবে মুক্তি পাবো? আদৌ মুক্তি পাবো কিনা? মানুষের মধ্যে একধরণের হতাশা কাজ করতো।
কিন্তু জুলাই মাসের শুরু থেকে এ দেশের ছাত্র-জনতা পরিস্থিতি পাল্টে দিতে শুরু করে। কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরুর মাধ্যমে তারা সর্বশেষ ১ দফা দাবিতে গণঅভ্যূত্থান সফল করেছে। এখন সে বিজয়ের মূহুর্ত। সচেতন দেশপ্রেমিক মহল এ প্রজন্মকে ফেসবুক, টিকটক প্রজন্ম বলে হতাশ ছিলো। দেশ ধ্বংসের অন্তিম সময়ে এসে ঠিকই এ প্রজন্ম দেশপ্রেমে উজ্জীবীত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন আন্দোলন করে যা পারেনি তরুণ প্রজন্ম মাত্র কয়েকদিনের গণআন্দোলনে তা করে দেখিয়েছে। তরুণ প্রজন্মকে স্যালুট।
নিশ্চয় দেশে একটি অন্তবর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে। অন্তবর্তী সরকারকে কঠিন পরিস্থিতিতে দেশ শাসনের দায়িত্ব নিতে হবে। একটা কথা বলতেই হবে যে, একটি অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজনের মাধ্যমেই গণমানুষ মুক্তির পূর্ণ স্বাদ পাবে। মানুষের পূর্ণ গণতান্ত্রিক মুক্তির জন্য মূল ভূমিকা পালন করতে হবে অন্তবর্তী সরকারকে। দেশের স্বাধীন বিচার বিভাগ বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার নেশায় বিগত ১৬ বছরে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। হাসিনার অঙ্গুলি হেলনে তার আজ্ঞাবহ আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ইশারায় বিচারপতিরা নিয়ন্ত্রিত হতো। কোনো বিচারপতি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভাবে বিচার কার্য পরিচালনা করতে চাইলে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হতো।
৪০ লাখের বেশি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৩৮ লাখের বেশি প্রতিহিংসা মূলক সাজানো মামলা দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই দীর্ঘদিন ফেরারী জীবনযাপন করছেন। অনেকেই বাড়ী-ঘর ছাড়া। তারা নিজের বাড়ীতে ঘুমাতে পারেনি।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বলতে গেলে শেষ করে দেয়া হয়েছে। মনিরুল ইসলাম, হারুনুর রশিদ, বিপ্লব কুমার সরকার ও মনোজ কুমার মজুমদার, শ্যামল দত্ত, সুভাস সিংহ, পঙ্কজ, কৃষ্ণপদ রায় ও মৃণালের মতো ঘৃণিত লোকদের কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের ঘৃণার পাত্র হয়েছে।
খুনী কৃষ্ণপদ রায় জামায়াত নেতা অ্যাডভোকেট ইমরুল কায়েস ও রাজধানীর খিলগাঁও থানা ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান জনি’র খুনী। খুনি কৃষ্ণপদ রায়-এর হুকুমে জনির শরীরে ১৭ গুলি করে তাকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়েছিলো। মতো ঘৃণিত লোকদের কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের ঘৃণার পাত্র হয়েছে।
জঙ্গি নাটকের নাট্যকার মনিরুল ইসলাম জঙ্গি নাটক করে অনেক নিরীহ মানুষ এমনকি ৮ মাসের অবোধ শিশুকে পর্যন্ত নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। যদিওবা আওয়ামী সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য তারা এসব বেআইনী কাজ করেছে। তবুও সরকারি কর্মচারীদের নীতি-নৈতিকতা ও রুলসের একটি বিষয় আছে। সেটা তারা মানেনি। এসব গণধিকৃত ও ঘৃণিত লোকদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে অবশ্যই অপসারণ করে এ বাহিনীকে জনগণের আস্থায় আনতে হবে।
একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখা খুবই জরুরি। আগেই বলেছি যে, দেশের নিরপেক্ষ প্রশাসন বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই।
অন্তবর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ হবে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করা। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন অভিযোগ করে বলেছিলেন, বাংলাদেশের প্রশাসনে নিয়োগ-পদোন্নতিতে ইন্ডিয়া হস্তক্ষেপ করে। ইন্ডিয়ার সুপারিশে নিয়োগ ও পদোন্নতি পাওয়া অফিসাররা প্রশাসনে এখনো ঘাপটি মেরে আছে। তাদের অবশ্যই অপসারণ করতে হবে।
দীর্ঘদিন যাবৎ রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলায় কারাগারে আটক নেতা-কর্মীদের সহসা মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
জনগণের গণতান্ত্রিক মুক্তি এমনিতেই আসেনি। জুলাই আন্দোলনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের পান্ডাদের গুলিতে অবোধ শিশু থেকে শুরু করে বহু মানুষ মারা গেছে। মানুষ দুনিয়া থেকে চলে গেলে তাকে আর কখনো ফিরে পাওয়া যায় না। নিহত ও জখম হওয়া মানুষের পরিবারকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন ও ক্ষতিপুরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের অবসানের পর অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিচ্ছে। এ সরকারের প্রতি জনগণের আশা-আকাঙ্খা ব্যাপক। জনগণের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই সরকারকে দেশ পরিচালনা করতে হবে। আরেকটি কথা বলতে হবে যে, অন্তবর্তী সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।
একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করাই হবে তাদের আসল কাজ। বিগত ২০০৮ সালের পর থেকে মানুষ ভোটের মাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারেনি। নির্বাচন ব্যবস্থা বলতে দেশে কিছুই ছিলো না। নির্বাচনের নামে শুধু তামাশা মঞ্চস্থ হয়েছে। সেসব তামাশা দেশের মানুষ আর দেখতে চায় না।
পরিশেষে অন্তবর্তীকালীন সরকারের সাফল্য প্রত্যাশা করে শেষ করলাম।
সাইয়েদ ইকরাম শাফী
গবেষক ও প্রাবন্ধিক
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized