গৌরাঙ্গুলা থেকে এবার কসবা কুল্লাপাথরের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা। এসব এলাকার প্রধান বাহন হলো সিএনজি এবং ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক। যদিও পূর্বে ব্যক্তিগত যানবাহন হিসেবে এ অঞ্চলের মানুষ পায়ে চালিত সাইকেল ব্যবহার করত। যান্ত্রিকতার এ যুগে তারা মোটরসাইকেল ব্যবহার করে। কুল্লাপাথর এর আগেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থাকতে একবার এসেছিলাম। কুল্লাপাথর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিজড়িত। এখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে নিহত হওয়া ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার সমাধি। যার মধ্যে ৪৫ জনের পরিচয় পাওয়া যায় এবং বাকি ৫ জন এখনও অজ্ঞাত।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। ভারত সীমান্তের নিকটবর্তী হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হতো। মুক্তির জন্য যে যোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের সমাধি দেখে মাথায় প্রশ্ন জাগে, ‘মুক্তি’ আসলে কী? মাঝে মাঝে নিজেকে এতো বেশি পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ দেখি যে নিজের মুক্তির জন্য ব্যকুল হয়ে পড়ি। এ এলাকার লোকজনের কাছে এটি শহীদ মিনার নামে পরিচিত। এ শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ব্যবসা। ব্যবসার ফাঁদটা বিশ্বব্যাপী এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যা থেকে বের হওয়া মুশকিল। আশেপাশে ছোট ছোট পাহাড় রয়েছে। যেখানে রয়েছে আম বাগান, মাল্টা বাগান, কাঁঠাল বাগানসহ নানা প্রজাতির ফলের বাগান। এখান থেকে অবশ্য কাশীরামপুর খুব বেশি একটা দূরে না। কাশীরামপুরই আমাদের অবস্থান স্থল।
হেঁটেই কুল্লাপাথর থেকে কাশীরামপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। রাস্তার দুপাশে ছোট পাহাড় একটু পর বিস্তৃত ফসলের মাঠ। অসাধারণ প্রকৃতি যা লেখে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। রাস্তায় জাকির ভাইয়ে সাথে অনেক কথা বলছিলাম। কথা বলছিলাম আত্মোন্নয়ন ও আত্মগঠন নিয়ে। তবে একটা বিষয় উপলব্ধি করলাম যে পারস্পরিক সরাসরি সাক্ষাতে একটা বিষয় নিয়ে যেভাবে আলোচনা করা যায়, অনলাইন বা ভার্চুয়ালি সেটা সম্ভব হয় না। তাছাড়া নানামুখী সমস্যা রয়েছে অনলাইনের। রাস্তার পাশের কাঠালবৃক্ষ ও খোলা মাঠের হাওয়া কী যে প্রশান্তির! ২০ থেকে ২৫ মিনিট হাঁটার পর আমরা জাবেদ ভাইয়ের মসজিদে আসি। মসজিদে আসতে আসতে যোহর নামাযের সময় হয়ে পড়েছিল। নামায শেষ করে দুপুরের খাবার খাওয়ার পালা। খাবার আসার আগে জাবেদ ভাই বলল উনার নাকি কসবা শহরে কাজ আছে। উনি দুপুরের খাবার না খেয়ে চলে গিয়েছিলেন। আমি আর জাকির ভাই দুপুরের খাবার শেষ করে বিশ্রাম নিতে যাই। ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নেওয়ার পর আসরের ওয়াক্ত হয়। আসরের নামায আদায় করলাম।
আষাঢ় মাসের আকাশ মেঘলা থাকাটা স্বাভাবিক। বিকেলে রোদ কম থাকায় একটু হাঁটতে বের হলাম তিনজনে। অসাধারণ আবহাওয়া না গরম না ঠান্ডা এক কথায় নাতিশীতোষ্ণ। বাতাস বইছিলো প্রচুর। হৃদয় যেন সে বাতাসে শীতল হয়ে পড়ল। একটু হেঁটে সামনে যাওয়ার পর বাঁশের তৈরি একটি মাঁচা পেলাম। বসে পড়লাম তিনজন। কথা বলছিলাম জরুরি কিছু বিষয় নিয়ে। একটু পর একজন স্থানীয় মুরব্বি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বসলেন। চারজন মিলে কথা বলছিলাম। মনে হচ্ছিল অনন্তকাল যদি এভাবে পারস্পরিক আলোচনা করতে পারতাম কতই না ভাল হতো!
ঝালমুঁড়ির গাড়ি দেখে ঝালমুঁড়ি খেতে ইচ্ছে হল। তিনজনে ত্রিশ টাকার ঝালমুড়ি খেলাম। জাবেদ ভাইয়ের সাথে দেখে এলাকার যে যায় সেই দাঁড়িয়ে অল্প সময়ের জন্য সৌজন্যতা রক্ষা করে। মাগরিবের সময় ঘনিয়ে আসছিল। আমাদেরও মসজিদে ফিরতে হবে। রাস্তায় আসার সময় চায়ের দোকানে বসে কয়েকজন মুরব্বি কথা বলছিল আমাদের ডাক দিয়ে চা খেতে বলল। একটি কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম জাকির ভাই চা পাগলা মানুষ। উনি চা একটু ভালই তৈরি করে। চায়ের আপ্যায়ন করে অসাধারণ!
মসজিদে এসে ওজু করে মাগরিবের নামায আদায় করি। তিনজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম এখন আর বের হব না। মসজিদের আঙ্গিনায় চেয়ার দিয়ে বসে একটু দর্শনচর্চা করব। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল সৃষ্টিতত্ত্ব, মানুষ, জীবন, মৃত্যু প্রভৃতি। আলোচনা বেশ মজাই লাগছিল। আসলে আমাদের এ ধরনের জ্ঞানচর্চা একদিকে নিজের যেমন উন্নত করে, অপরদিকে নিজের চিন্তার উন্নয়ন ও প্রসারণ ঘটায়। জাকির ভাইয়ের সাথে আমার অর্থনৈতিক কিংবা কাজের সূত্রে সম্পর্ক নয়। দুইজনের চিন্তাসূত্রে সম্পর্ক। কথা কাটাকাটি হয়। আবার চিন্তার মতানৈক্যও দেখা যায়। তবুও সম্পর্কটা অনেক মজবুত। তবে পর্যবেক্ষণসূত্রে বলতে পারছি না স্থায়ী। আমরা মানুষের মাঝে ঐক্যের বন্ধন তৈরি করতে ভবঘুরের মত জীবনযাপন করি, চিন্তা করি।
জাকির ভাই বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও আমার সাথে সব ছেড়ে মসজিদে নিজেদের উন্নয় ঘটাতে সময় দিতে চলে এসেছেন। যদিও আমি অবিবাহিত। আমার পিছুটান খুব বেশি একটা নেই। তবুও জীবনের প্রয়োজনে নানাদিকে ছুটে চলি। আমাদের সম্পর্কে সেতু হিসেবে কাজ করে ‘দেশ দর্শন’ পত্রিকাটা। দুইজনে বহুরাত একসাথে অতিবাহিত করেছি শুধু পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য। কথা কী আর শেষ! আজীবন বলেও শেষ করতে পারব না। এশর নামায আদায় করার সময় হয়েছে কথার ইতি টানতে হলো।
এশার নামায আদায় করে জাকির ভাই এবং আমি দুইজনে খালি পায়ে হাঁটব সিদ্ধান্ত নিলাম। দুইজনে খালি পায়ে হাঁটা শুরু করলাম। একবারে নির্জন রাত্রি। দুইজনে হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথ হচ্ছিল। কিভাবে মানুষের অস্থিরতা কমানো যায়? বিশ্বের মাঝে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে তা বন্ধ করতে আমাদের কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন? ক্ষমতার রাজনীতি বন্ধ করে কী করে সুষ্ঠ-সুন্দর আগামীর পৃথিবী গড়ে তোলা যায়? অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমাদের করণীয় কী কী? মানুষের চিন্তা পরিবর্তনে আমাদের করণীয় কী? প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কথা চলে।
যেখানে এসব বিষয় নিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এসি লাগানো কক্ষে বসে গবেষণা চলছে। সেখানে আমরা দুইজন খোলা আকাশের নিচে খালি পায়ে হেঁটে গবেষণা, চিন্তা, আলোচনা করছি। আসলে ইচ্ছা থাকলে যে কোনো জায়গায় মানুষ তার গবেষণাগার স্থাপন করতে পারে। কথা বলতে বলতে রাতের কুল্লাপাথর দেখতে চলে আসলাম। দিনে যেখানে হাজার মানুষের সমাগম থাকে রাতে সেখানে একেবারে ফাঁকা। দুইজন আবার হাঁটা শুরু করেছি মসজিদে ফিরতে। মসজিদে ফিরে আসার পর হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। রাতের খাবার আসল। তিনজনে একসাথে বসে রাতের খাবার খেলাম। খাওয়া শেষ করে পূর্বের রাতের মত মসজিদে চলে যাই বিশ্রামের জন্য।
চলবে…
শরীফ উদ্দীন রনি
সাংবাদিক, কলামিস্ট
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized
Pingback: আত্মশুদ্ধির সফরে: কসবা পানিয়ারূপ (শেষ পর্ব) – দেশ দর্শন