মহান আল্লাহর প্রতি সম্মান ও ভক্তি প্রদশর্নের একমাত্র জায়গা হলো মসজিদ। এটা কোনো ক্লাবঘর বা বাজার নয়। তাই এখানে সময় কাটানোর জন্য অন্যের ইবাদতের বিঘ্ন করে বিরামহীনভাবে কোনো আড্ডা দেওয়া যাবে না। মসজিদে অমুসলিমদের কোনো মতবাদ প্রচার করা যাবে না, এমনকি তাদের কোনো ধরনের ইবাদতও করা যাবে না। মসজিদে কারো ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য বা মুসল্লিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয় এ ধরনের কোনো উস্কানি মূলক বক্তব্য দেওয়া যাবে না। ইদানিং দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশের বেশিরভাগ মসজিদে নির্বাচনকালীন সময়ে প্রার্থীরা মুসল্লিদের কাছে ভোট চায়। এ ধরনের কার্যকলাপ ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। কারণ, বিষয়টি ব্যক্তিগত স্বার্থ সম্পর্কিত। সুতরাং কাউকে কখনো ভোট চাওয়ার জন্য মসজিদকে ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। তবে প্রার্থী মসজিদের বাইরে মুসল্লিদের নিকট ভোট চাইতে পারবে। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে তাহলে মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট হবে। এ ব্যাপারে মুসল্লিসহ মসজিদ কমিটিকে সর্তক থাকতে হবে।
বস্তুত, মসজিদ এমন একটি স্থান যেখানে প্রভাবশালী-নিরীহ, উচু-নীচু, ধনী-গরীব, সাদা-কালো কোনো ধরনের ভেদাভদ থাকে না। এখানে সবাই সমান এবং সবাই একই কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে। বৈষম্যহীন এই মানসিকতা প্রতিটি মুসলিমকে ব্যক্তি জীবনে বাস্তবায়নের জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। “মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই”- এই আদর্শের ভিত্তিতে মসজিদের ভিতরে ও বাইরে সকল মুসলিমদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক অটুট রাখতে হবে। আর কোনো মুসল্লির মধ্যে এই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ন্যূনতম অবনতি হলে মসজিদ কমিটি উদ্যোগী হয়ে তা নিস্পত্তি করে দিবে। কারণ, এটা মসজিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
মুসলিমদের পবিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট জায়গা হলো মসজিদ। এখানে আসা-যাওয়ার সময় তাড়াহুড়ো করা যাবে না। প্রতিটি মুসল্লিকে মসজিদে প্রবেশ করার সময় তার চারিত্রিক দুর্বলতাগুলো পেছনে ফেলে আসতে হবে। মসজিদে আস্তে কথা বলতে হবে, উচ্চস্বরে বা চিৎকার করে কথা বলা যাবে না। অপ্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় আলাপ মসজিদে করা যাবে না। তবে প্রয়োজনী, গুরুত্বপূর্ণ ও সৃজনশীল আলাপ ভদ্রভাবে মসজিদে করা যাবে। মহান আল্লাহ বলেন,”নিশ্চয়ই মু’মিনগণ সফলকাম হয়েছে। যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র। যারা অনর্থক বিষয় থেকে দূরে থাকে।” (সুরা মু’মিনুন :১-৩)। কিন্তু ইদানিং কিছু কিছু মসজিদের দেওয়াল লিখা থাকে, মসজিদে দুনিয়াবী কথা বলা নিষেধ।” পাশাপাশি আরো লিখা থাকে,” মসজিদে কথাবার্তা নেক আমল খায়, যেরূপ পশু ঘাস-খড় খায়।” তবে বিজ্ঞ আলেমদের মতে, এগুলো জাল হাদীস।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে, মহানবী (সা.) যেস্থানে ফজরের নামাজ আদায় করতেন সেখানে সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে থাকতেন। সূর্যোদয়ের পরে সেখান থেকে উঠতেন। তার বসা অবস্থায় সাহাবীগণ কথাবার্তা বলতেন, জাহেলী যুগের আলোচনা করতেন, কবিতা পাঠ করতেন এবং হাসতেন। আর মহানবী(সা.) শুধু মুচকি হাসতেন।(সহীহ মুসলিম :১/৪৬৩, আস-সানানুল কুবরা :১/৪০৪, ৬/৫১)। সুতরাং এ ধরনের জাল হাদিসা মানুষকে ধর্ম সম্পর্কে বোঝা ও জানার ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে। এমনকি মুসল্লিদের পারস্পরিক ঐক্যের ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকেও বাধাগ্রস্ত করবে।
লক্ষলীয় ব্যাপার হলো, গালিগালাজ, গিবত, লোভ, অন্যায় কথা মসজিদে যেমন হারাম, তেমনি মসজিদের বাইরেও হারাম। একইভাবে ভদ্রতাসূচক শালীন সব ধরনের কথাবার্তা বাইরে যেমন জায়েজ, মসজিদেও জায়েজ। তাই মসজিদে দুনিয়াবী কথা বলা হারাম কথাটি এভাবে না বলে, মসজিদে অশ্লীল ও অনর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকি এবং মসজিদের বাইরেও এসব না করি-এভাবে বলাই শ্রেয়।
বস্তুত, কোনো দ্বীনী কাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার পর প্রসঙ্গক্রমে দুনিয়াবী কোনো বৈধ কথাবার্তা বলা জায়েজ এবং এর বৈধতা রাসলল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমানিত।(সহীহ বুখারী:১/৬৩,৬৪,৬৫)। সুতরাং মুসল্লিদের মধ্যে সম্প্রীতির ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় রাখার স্বার্থে প্রতিটি মসজিদ কমিটির দায়িত্ব এধরনের জাল হাদিসের প্রচার বন্ধ করা।
পবিত্র রমজানের বিশেষ ইবাদত হচ্ছে তারাবি নামাজ। বেশিরভাগ মুসল্লি এই নামাজ মসজিদে আদায় করে থাকেন। তারাবি নামাজ মূলত আরামের নামাজ। ইসলামি শরিয়তের নিয়ম অনুযায়ী, এই নামাজে প্রতি চার রাকাত পর পর চার রাকাত পরিমান বসে আরাম করার বিধান রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এই সহিহ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটছে যুগ যুগ ধরে। এখানকার মসজিদগুলোতে ঝড়ের গতিতে দ্রুত বেগে তারাবি নামাজ আদায় করা হয়!! এ ক্ষেত্রে কোরআন পাঠের সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটছে!! ফলে কোরআন শ্রবনের মাধ্যমে মুসল্লিদের অন্তরে যে স্বাদ অনুভব করার কথা, সেটা হচ্ছে না এবং তারাবি নামাজের সওয়াবও নষ্ট হচ্ছে।
এই প্রেক্ষিতে ইসলামি আইনবিদদের অভিমত হলো, যে গতিতে পবিত্র কোরআন পড়লে শব্দাবলি বোঝা যায়, ন্যূনতম সেই গতিতে পবিত্র কোরআন পড়তে হবে। তবে যে গতিতে পড়লে কিছুই বোঝা যায় না, সে গতিতে পড়া বৈধ নয়, এর দ্বারা কোনো সওয়াবও হবে না। ( ফতোয়ায়ে শামি : ২/৪৭, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/১১৭)।
তাই প্রতিটি মুমিনের উচিত তারাবি নামাজ আদায়ের সময় সুস্পষ্টভাবে ও ধীরস্থিরভাবে কোরআন তেলায়াত করা। এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেছেন,” আর কোরাআন পাঠ করুন ধীর ধীরে, খুব স্পষ্টভাবে।” ( সুরা মুজ্জামিল : ৪)। সুতরাং দ্রুত গতিতে তারাবি পড়ার সংস্কৃতি থেকে সকল মুসল্লিকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই নামাজ আদায়ের সময় হাফেজদেরকে অবশ্যই সুমিষ্ট কন্ঠে ও সুস্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কোরাআন তেলায়াত করতে হবে। মসজিদ কমিটিকে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখতে হবে। এটা তাদের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আমাদের সমাজে গরিব ও এতিম যুবক ছেলেমেয়েরা নিজেদের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বিবাহের কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম হয় না। এর ফলে সমাজে তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধও সংগঠিত হয়ে থাকে। এর বাস্তবতাও আমাদের সমাজে স্পষ্ট। এই অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য সমাজের ধনাঢ্যদের কাছে থেকে বিশেষ অনুদান নিয়ে মসজিদের মাধ্যমে তাদের বিবাহ সম্পাদন করা যেতে পারে। পাশাপাশি নব-দম্পতিদের পুনর্বাসনের জন্য কিছু টাকাও উপহার হিসেবে দেওয়া যেতে পারে।
মসজিদ-মাদ্রাসা নিমার্ণ করার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা, দ্বিনি মাহফিলের আয়োজন করা নিঃসন্দেহে সওয়াবের কাজ। প্রত্যেকের উচিত, সামর্থ্য অনুযায়ী, এসব কাজে আত্মনিয়োগ করা। এসব কাজে সহযোগিতা করা পরকালের জন্য বিনিয়োগের শামিল। কিন্তু এগুলোর জন্য কাউকে লজ্জায় ফেলে বা কৌশলে বা জোর করে অর্থ সংগ্রহ ইসলাম কখনো অনুমোধন করে না। এসব কাজে অর্থ দিতে হবে স্বেচ্ছায় বা সন্তুষ্টচিত্তে।
বর্তমানে রাস্তা-ঘাটে দেখা যায়, কিছু মানুষ আলেমদের বেশ নিয়ে বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসার নামে চাঁদা তুলে বেড়ায়। এছাড়া রাস্তা-ঘাটে কাউন্টার বসিয়ে েদূরপাল্লার বাস স্টেশনে বাসে বাসে মসজিদ-মাদ্রাসা ও মাহফিলের জন্য চাঁদা তোলা হয়। এমনকি চাঁদা কালেকশনের কাজে শিশুরদরকেও ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞ আলেমদের মতে, দ্বিনি কাজে চাঁদা কালেমশনের এমন পদ্ধতি ভিক্ষাবৃত্তির সমতুল্য এবং তা ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এমন পদ্ধতিতে চাঁদা কালেকশন বন্ধ হওয়া উচিত। ইসলাম কখনো তা সমর্থন করে না।
উল্লেখ, রাসূল (সা.) বা সাহাবাদের সময় মসজিদ-মাদ্রাসা নিমার্ণের জন্য টাকা সংগ্রহের এধরনের কোনো পদ্ধতি বা নিয়ম-নীতির প্রচলন ছিল না। ওই সময় মসজিদ-মাদ্রাসাসহ সমাজিক অন্যান্য উন্নয়ন মূলক কাজের খরচ বাইতুল মাল থেকে বহন করা হতো।
বস্তুত, মসজিদ-মাদ্রাসা জন্য রাস্তার মোড়, পাবলিক বাসে, ট্রেনে, হাট-বাজার, দোকান-পাট, বাড়ি-ঘরে দলবদ্ধভাবে গিয়ে চাঁদা বা অর্থ বা অন্যান্য সামগ্রী কালেকশন অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং ভিক্ষাবৃত্তির-ই-শামিল। ইসলাম এ ধরনের কাজ করাকে চরম নিরুৎসাহিত করেন। (বুখারি:১৪২৭,৬৪৭৩, মুসলিম:২২৮৬,২২৮৮)।
সুতরাং এভাবে মসজিদ-মাদ্রাসা বা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিমার্ণ ও এর ব্যয়নির্বাহের জন্য চাঁদা কালেকশন আল্লাহর মহত্বকে খাটো করে নেওয়ার সমতুল্য। এটি একটি নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। এই নাজায়েজ কাজ বন্ধের জন্য মসজিদের উদ্যোগে সমাজের ধনাঢ়্যদের কাছ থেকে একটি নিদির্ষ্ট হারে অনুদান নিয়ে একটি ফান্ড গঠন করা যেতে পারে। অতঃপর ওই ফান্ড থেকে অর্থ নিয়ে মসজিদের তত্ত্বাবধানে মসজিদ-মাদ্রাসা ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিমার্ণ করা যেতে পারে।
মানুষ সৃষ্টির সেরাজীব। সমাজে সেই মানুষেরই একটা অংশ গরীব-দুস্থ। তারা আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গরীব-দুস্থসহ সমাজের আশ্রয়হীন দুবর্ল ও অসহায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা ইসালামের অন্যতম ইবাদত। অসচ্ছল, বিপদগ্রস্ত এবং অভাবী মানুষের সাহায্যে কেউ এগিয়ে এলে আল্লাহ খুব খুশি হন। আল্লাহ বলেন, ” তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারও উপাসনা করবে না। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, এতিম-দীন-দরিদ্রের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে, মানুষের সঙ্গে সৎ কথাবার্তা বলবে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত দেবে।” ( সুরা বাকারা : ৮৩)।
তাই গরীব-অসহায়, দুস্থের প্রতি আন্তরিক ভালোবাস প্রদর্শন ও সহানুভূতিশীল হওয়া অত্যাবশ্যক। ভ্রাতৃত্বের নৈতিক ও মৌখিক দাবি হলো, একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং বিপদাপদে পাশে দাঁড়ানো। এই প্রসঙ্গে মহানবী(সা.) বলেছেন, ” তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নাও, বস্ত্রহীন লোকদের বস্ত্র দাও এবং বন্দিকে মুক্ত করে দাও। তোমরা পরকালে এর বিনিময় পাবে।” ( বোখারি :২৪১৭, তিরমিজি : ২৮৩৫, মুসলিম : ২৪১৯)।
অবাক হওয়ার বিষয়, আমাদের দেশের মানুষ অসহায় মানুষকে সাহায্য করার চেয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সাহায্য করে বেশি!! তাদের ধারণা, অসহায়-দুঃখী মানুষকে সাহায্য করার চেয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান করা বেশি সওয়াবের কাজ!! এধরনের ধারণারও একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে। যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশের আলেম সমাজ মসজিদ-মাদ্রাসায় দানের কথা বিভিন্ন মাহফিলে ও মসজিদে নিয়মিতভাবে বলে আসছেন ; কিন্তু সেই তুলনায় অসহায়-দুস্থদের সাযাহ্য করার কথা কম বলে থাকেন। আর সে কারণেই সাধারণ মানুষের মাঝে অসহায়-গরীব মানুষকে সহায়তা করার আগ্রহ কম দেখা যায়।
অথচ, মসজিদ-মাদ্রাসায় দানের ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে পবিত্র কোরআনে কোনো আয়াত নেই। এমনকি মসজিদ-মাদ্রাসার চেয়ে গরীব-অসহায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য হাদিসও রয়েছে প্রচুর। এমতাবস্থায় প্রতিটি মুমিনের উচিত সামর্থ্য অনুযায়ী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচর্যা করা, অসহায় দরিদ্রদের থাকা-খাওয়া ও কাজের ব্যবস্থা করা। সুতরং মসজিদের বিশেষ ফান্ড থেকে অর্থ নিয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের পাশাপাশি অসহায়-দুস্থদের সার্বিক মঙ্গলার্থে মসজিদের মাধ্যমে তা ব্যয় করা যেতে পারে। (চলবে)।
খায়রুল আকরাম খান