সাধারণত যুদ্ধকালীন সময়ে শক্রপক্ষকে ধরার জন্য এ ধরনের অভিযান পরিচালিত হয়ে থাকে। যেমনটি বর্তমানে ফিলিস্তিনের গাজা শহরে হচ্ছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এমন ভয়াবহ দৃশ্য দেখা যায়নি। তাহলে কি বর্তমানে যুদ্ধকালীন অবস্থা বিরাজ করছে?
দৈনিকা প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, গত দশদিনে অর্থাৎ ১৭ থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে শিক্ষার্থী, বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও বিভিন্ন পেশার মানুষ নিহত হয়েছে ২০৯ জন, সারা দেশে অন্তত ৫৫৫ টি মামলা হয়েছে এবং গ্রেপ্তার হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ২৬৪ জন!! এদিকে গত ২৬ জুলাই কোটা আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক যথাক্রমে-নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে চিকিৎসাধীন অবস্থা ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে গিয়েছে!! আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এহের আচরণে মনে হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলন করে সংবিধান লঙঘন করেছে। অথচ, এটা ছিল তাদের সাংবিধানীক অধিকার।
উল্লেখ্য, মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি পাওয়া সব ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য সাংবিধানীক অধিকার, যে অধিকার ২০১৮ সালে বর্তমান সরকারই স্বীকার করে নিয়েছিল। ২০২৪ সালের জুনে হাইকোর্টের রায়ে সেই অধিকার হারাতে বসেছিল তারা। সুতারাং, এই কোটা সংস্কার আন্দোলনে চাওয়া ছিল খুবই ন্যায্য। গত ২১ জুলাই ছাত্রছাত্রীদের এই ন্যায্যতা স্বীকার করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছে। ওই রায়ে ৯৩ শতাংশ সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ও ৭ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছে।
সর্বোচ্চ আদালতের এই ঐতিহাসিক রায়ের পরপরই কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ সচল করা, শিক্ষার্থীদের হল খুলে দেওয়া, সমন্বয়কদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও কারফিউ প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরাও মনে করি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য এই উদ্যোগগুলো গ্রহণ জরুরি।
কোটা সংস্কার বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সরকারের কাছে সুনিদির্ষ্ট কিছু দাবিনামা পেশ করেছেন। এর মধ্যে কোটা সংস্কারের পাশাপাশি অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়া, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়া ও তাঁদের হয়রানি না করা, প্রতিটি খুনের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস এবং নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিষয়টি অন্যতম। সংকট নিরসনে শিক্ষার্থীদের এসব দাবির ব্যাপাারে সরকার বাহাদুরকে অবশ্যই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
একদিকে সরকার বলছে, শিক্ষার্থীরা নাশকতা করেনি, আবার অন্যদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত থাকার জন্য শিক্ষার্থীকে গণহারে গ্রেপ্তার করছে বা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এখন প্রসঙ্গক্রমে প্রশ্ন আসে-যদি শিক্ষার্থীরা নাশকতা না করে থাকে, তাহলে তাদেরকে গ্রেপ্তার বা তুলে নেওয়া হচ্ছে কেন? দৈনিক আজকের পত্রিকার ২০২৪ এর ২৮ জুলাই প্রকাশিত সংবাদের তথ্য অনুযায়ী, ২৭ জুলাই পযর্ন্ত সারা দেশে প্রায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে তুলে নেওয়া হয়েছে। সরকারের এধরনের দ্বিমুখী আচরণ খুবই রহস্যজনক।
এইদিকে সরকারের এই দ্বিমুখী আচরণের প্রতিবাদে গত ২৭ জুলাই রাতে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম ‘গুগল মিটে’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ, মো. মাহিন সরকার ও রিফাত রশিদ যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সরকারকে সারা দেশে গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেওয়া, গুম হওয়া শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে দেওয়া এবং দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে।
তারা আরো জানিয়েছে, কোটা সংস্কার শুধু পরিপত্র নয়, কমিশন গঠন করে সব অংশীজনের মতামত নিয়ে কোটা সংস্কার স্থায়ী সমাধানে সংসদে আইন পাস করতে হবে এবং দেশব্যাপী ছাত্র হত্যার দায়ে জড়িত মন্ত্রী থেকে পুলিশের কনস্টেবলদের অব্যাহতি দিয়ে আইনের আওতায় আনতে হবে। যদি তা না করা হয়, তাহলে তারা কঠিন কর্মসূচি দিয়ে আবার রাজপথে নামবে। এখন মনে হচ্ছে, অবস্থা ক্রামান্বয়ে ভয়বহতার দিকে যাচ্ছে।
বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে বলপ্রয়োগ ও ভয়ভীতি নয়, শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ও আলোচনার মাধ্যমে সরকারকে বর্তমান সমস্যার স্থায়ী সমধান করতে হবে। মানুষকে ভয় দেখিয়ে, নিপীড়ন করে সাময়িকভাবে দমন যায়, অন্ততকাল দমন করা যায় না। মানুষের স্বজন হারানোর বেদনা ও তার বুকের ক্ষত কখনো মোচন করা যায় না। শিক্ষার্থীদের বুকে রয়েছে রংপুরের আবু সাঈদের বুকে পুলিশের গুলি চালিয়ে হত্যার মতো বহু দৃশ্য, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের লাঠিপেটা, রক্তাক্ত ও লাঞ্ছিত করার বহু টুকরা স্মৃতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে নামানোর প্রকাশ্য নির্দেশ। সরকারকে এসব দায় স্বীকার করে দ্রুত গণগ্রেপ্তার বন্ধ করে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে এবং সকল প্রকার দমনপীড়ন, ভয়তীতি ও ছলচাতুরী চিরতরে পরিহার করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে আত্মসমালোচনা, সহমর্মিতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এগোতে হবে।
বস্তুত, কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি ছিল সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ। সেটি কিভাবে ও কাদের উসকানিতে প্রাণঘাতী সংঘাতে রূপ নিল, তা অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে হবে। সব দায় কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। যারা রাষ্ট্রীয় কিংবা বেসরকারি সম্পদ ধ্বংস করেছে, সরকার তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু তদন্তের আগেই যখন সরকারের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে ঢালাওভাবে কারও ওপর দায় চাপানো হয়, তখন জনমনে সন্দেহ না জেগে পারে না।
বিরোধী দলের শত শত নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার এবং হাজার হাজার অজ্ঞতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে যেভাবে মামলা করা হচ্ছে, সেটাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা কঠিন। বিভিন্ন স্থানে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদেরও সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা গেছে। অথচ মামলা করা হচ্ছে বেছে বেছে শিক্ষার্থী ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এটা আইন নিজস্ব গতিতে চলার লক্ষণ নয়।
এ মুহূর্তে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা বন্ধ আছে। যেখানে এক দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে লাখ লাখ শিক্ষার্থী ক্ষতির সম্মুখীন হয়, সেখোন দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার ক্ষতিটা সহজেই অনুমান করা যায়। করোনা মহামারি ছাড়া সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এত দিন বন্ধ রাখার নজির নেই। এভাবে দিনের পর দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে দেশ কেবল মেধাশূন্যই হবে না, শিক্ষাশূন্য হয়ে যাবে।
সরকার বাহাদুরকে মনে রাখতে হবে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার না করে কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে শিক্ষাঙ্গনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না। একটা সময় অর্থনীতির ক্ষতি হয়তো টাকা দিয়ে পোষানো যাবে, কিন্তু শিক্ষার ক্ষতি কোনোভাবেই পোষানো যাবে না। সরকার যত দেরি করবে, শিক্ষার ক্ষতি তত বাড়তে থাকবে।
সরকার বরাবরই বলছে, শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনটি যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত। তাহলে এই আন্দোলনে যদি কোনো রাজনৈতিক দল সমর্থন দিয়ে থাকে, সেটি অপরাধ নয়। তবে অপরাধ তখনই হবে যদি কেউ আন্দোলন দমন কিংবা সমর্থনের নামে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায়; রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কারও বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। ঢালাও গ্রেপ্তার কিংবা পাইকারি মামলা বিচারপ্রক্রিয়াকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করবে, তেমনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রেও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন ও যারা সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের সাথে জড়িত নন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হবে না বা কোনো ধরনের হয়রানি করা হবে না-সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে এ ধরনের নিশ্চয়তা পাওয়ার পরও দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিখোঁজ ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ আসছে। সুতরাং চলমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হলে সরকারকে শিক্ষার্থীদের দাবিনামা মেনে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খোলার সময়সূচি ঘোষণা করতে হবে।
ইতিমধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশে অনেক প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন অগনিত। রাষ্ট্রীয় সম্পদেরও প্রভূত ক্ষতিসাধন হয়েছে। এসব অপ্রত্যাশিত ঘটনা কোনোভাবেই আর বাড়তে দেওয়া যায় না।
বিগত কয়েক দিনের এই সহিংসতা, অস্থিরতা ও কারফিউর কারণে জনজীবন ও দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। আমদানি-রপ্তানিতে কার্যত অচলাবস্থা চলছে, বন্ধ হয়ে গেছে কারখানার উৎপাদন ও ইন্টানেট সেবা। বাংলাদেশ কার্যত পুরো বিশ্ব থেকে ডিজিটাল পরিসরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো উদ্বেগ ও শঙ্কা জানিয়ে দ্রুত সংকট নিরসনে সরকারের নিকট আহ্বান জানিয়েছে। সরবরাহে ঘাটতির কারণে ঢাকাসহ সারা দেশে সবজি, মাছ, মোরগ, ডিমসহ নিত্যপণ্যের দাম আরও এক দফা বেড়েছে। অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের রুটি-রুজির অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
সুতরাং দেশজুড়ে বর্তমানে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে, জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং অর্থনীতির চাকা সচল করতে অবিলম্বে ইন্টারনেট সেবা চালু ও কারফিউ প্রত্যাহার করা অতীব জরুরি।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com