গত ৫ আগস্ট রোজ সোমবার শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার আর টিকে থাকতে পারেনি। সরকার পতনের পর সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান সবাইকে শান্ত থাকতে বলেছেন। সব ধরনের হিংসাত্মক কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে বলেছেন ছাত্র-জনতাকে। অন্তবর্তীকালীন সরকার এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে, জনগণ যদি তাদের সহযোগিতা করেন-এ কথাও বলেছেন সেনাপ্রধান। তিনি কিছুটা সময় চেয়েছেন। সব হত্যার বিচার হবে বলে জনগণকে আশ্বাস দিয়েছে। রাজপথে বেরিয়ে আসা ছাত্র-জনতাকে শান্তিপূর্ণভাবে যার যার বাসস্থানে ফিরে যেতে সেনাপ্রধান বিশেষ অনুরোধ করেছেন।
এই দিকে এই বিজয়ের আনন্দে ছাত্র-জনতা রাজপথে উল্লাস করছে। কিন্তু তারা সেনাপ্রধানের এই আহ্বানে তেমন একটা সাড়া দেয়নি। উল্লেখ্য, সেনাপ্রধানের এই ভাষণ শেষ হওয়ার আগে থেকেই ঢাকা শহরে ছিল সাধারণ মানুষের ঢল। তাঁর ভাষণ শেষ হতে না হতেই ছাত্র-জনতা ঢুকে পড়ে গণভবনে। ওই ভবনে যা কিছু ছিল, তা লোপাট হয়ে যায় অতি অল্প সময়ে।
সাধারনত যেকোনো বড় বিক্ষোভের সময় অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তের মধ্যেই। বিজয়ী শক্তি পরাজিত শতক্তির ওপর প্রতিশোধ নেয়। শ্রীলঙ্কা, ইরাক ও লিবিয়ায় এমনটি হয়েছিল। কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রণে আসার চেষ্টা থাকাটা অতীব জরুরি। যত কম সময়ে এই অরাজকতা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তত তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক সময়ে ফিরে আসা যায়। শেখ হাসিনা সকারের পতনের পরও সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় জ্বালাও-পোড়াও ও ভাঙ্গচুরের মতো ঘটনা ঘটেছে!! এসব অনাকাঙ্খিত ঘটনা প্রতিরোধ করতে না পারলে এই পরিবর্তন কোনো কাজেই লাগবে না।
বস্তুত, বাংলাদেশকে সত্যিকারের বৈষম্যহীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে গণতান্ত্রিক নীতি-নৈতিকতা মেনে চলা অতীব জরুরি। দুঃখজনক ব্যাপার হলো আমাদের দেশে সেই ধরনের কোনো চর্চা নেই। সাধারণ নিয়মেই নিবার্চনী খেলায় কোনো দল পরাজিত হতে পারে বা জয়ী হতে পারে। তবে আমাদের দেশে কোনো দল নির্বাচনী খেলায় জয়ী হলে বা আন্দোলনের মাধ্যমে কোনো দলকে পদত্যাগে বাধ্যকরার পর করার পর ক্ষমতায় এসে পরাজিত দলের লোকদের বাড়িঘরে আগুন দেয় ও লুটপাট অব্যাহত রাখে। তবে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের ধারা সুপ্রতিষ্ঠত করার জন্য আমদেরকে এই ধরনের ভয়াবহ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আমাদের সমাজে বিভিন্ন বর্ণ-গোত্র ও সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করছে সেই আদি কাল থেকেই। কাজেই সামাজে নানা ধরনের মতবাদ থাকবেই। কিন্তু সেই মতবাদ লালন বা প্রকাশের কারণে যেন একজন অন্যজনের শক্রতে পরিণত না হয়, সেই দিকটির প্রতি সবার এগে খেয়াল রাখা দরকার। পাশের বাড়ির লোকটি তো আমার পড়শি, অতি ঘনিষ্ঠজন, তাকে শক্র ভাবলে সমাজ এগোবে কি করে? তখন তো শুধু নিজের দলের বাইরে আর সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখবে মানুষ। শুধু তা-ই নয়, অন্যের সমস্যা-অসুবিধাকে গ্রাহ্যই করবে না জয়ী দলের মানুষেরা। এতে ক্ষমতাসীন দলে হয়ে পড়বে জনবিচ্ছিন্ন। সে কথা আগামীতে ক্ষমতায় আসা বিজয়ী দলকে সব সময় স্মরণ রাখতে হবে। তাদেরকে আরো মনে রাখতে হবে, দেশটা কোনো গোষ্ঠী বা দলের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এ দেশ সবার।সবার শ্রম ও ঘামের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত। সুতারাং সমাজের আপামর জনগণকে উপেক্ষা করে বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া যায় না। সমাজে বসবাসরত প্রতিটি লোককেই গুরুত্ব দিতে হবে।
আমরা না চাইলেও সরকার পরিবর্তনের জন্য প্রায় ১০/১২ বছর পর পর ভোটের পরিবর্তে আন্দোলনের আশ্রয় নিতে হয়। এতে প্রচুর জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এটা আমাদের জাতির জন্য একটি ভয়াবহ দিক। প্রসঙ্গত, এরশাদবিরোধী আন্দোলন, মাগুরা নির্বাচনের পর খালেদা জিয়াকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন করতে বাধ্য করা এবং এবার শেখ হাসিনা সরকারক ক্ষমতাচ্যূত করা এ গুলো অন্যতম উদাহরন। কেন বার বার জনগণকে সরকার পরিবর্তনের জন্য রাস্তায় নেমে আসতে হচ্ছে, সে কথাও রাজনীতিকদের ভাবতে হবে। মূলত গণতন্ত্র অরক্ষিত হলেই সাধারণ জনগণ রাজপথে নেমে আসে।
আমাদের দেশে নির্বাচিত ও অনির্বাচিত সরকারের কোনোটাই এখন পর্যন্ত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এবারকার আন্দোলনের ফসল যারা ঘরে তুলবেন, তারা সেই ফসল জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে কিনা, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। একটি প্রবাদ আছে, ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।’ সেই পাকিস্তান আমল থেকে গণতন্ত্রের জন্য কত না সংগ্রাম, কত না আত্মাহুতি, কিন্তু গণতন্ত্র নামক বস্তুটি সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেল। তার দেখা দুস্কর হয়েই রইল।
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করার পর এখন দেশে আইনানুগ কোনো সরকার নেই। একটি নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। আশা করা যাচ্ছ, আজ-কালকের মধ্যে আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজ, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি, নাগরিক সমাজ ও সংবিধানবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি গ্রহণযোগ্য অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের কাজটি দ্রুত সম্পন্ন হবে।
আমরা আশা করছি, জনগণের অংগ্রহণে নির্বাচন নিশ্চত করা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সমুন্নত রাখা, ঘুষ-দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা, ব্যাংক সেক্টরের অরাজকতা দূর করা, ঋণখেলাপিদের শায়েস্তা করা, সিন্ডিকেট ব্যবসা উচ্ছেদ করা, দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায় রাখা, প্রশ্নপত্র ফাঁসবিষয়ক দুর্নীতিসহ আরও যেসব অব্যবস্থা আমাদের ঘাড়ের ওপর চেপে বসে আছে, সেগুলো দূর করার ব্যাপারে এই অন্তর্বীকালীন সরকার পদক্ষেপ নেবে।
গত কয়েক দিনের আন্দোলনে যে তিন শতাধিক প্রাণ গেছে, তাদের পরিবারের প্রতি রইল আমাদের গভীর সমবেদনা। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, আমরা তাঁদের অভিনন্দন জানাই। তাঁরা তাঁদের ত্যাগ ও সংগ্রাম দিয়ে যে বিজয় অর্জন করেছেন, তা যাতে কেউ নস্যাৎ না করতে পারে, সে ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized