গত ৮ আগস্ট রাতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। নতুন সরকারকে আমরা অভিনন্দন জানাই। সহিংস গণ-আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর দেশ কার্যত সরকারবিহীন হয়ে পড়ে। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে সেই শূন্যতা পূরণ হয়েছে। একই সঙ্গে দেশ এক অনিশ্চিত পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেল।
বাংলাদেশে বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল বিরাজ করছে। গণহারে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পদত্যাগ করছে। ব্যাংকে ব্যাংকে অসন্তোষ। মিল-কারখানা সব এখনো চালু হয়নি। পুলিশের সব সদস্য এখনো কাজে নামেনি। রাস্তাঘাট নিয়ন্ত্রণ করছে ছাত্রছাত্রীরা। রপ্তানি বাণিজ্য বিঘ্নিত, পাইকারি-খুচরা বাজারের চেইন বিঘ্নিত-এসব অবশ্যই অপ্রত্যাশিত। অর্থনৈতিক ধাক্কা। এটা ‘তৃতীয় ধাক্কা’, যা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। এই অর্থে এবারের ধাক্কা সুদূরপ্রসারী। কি থেকে কি হয়ে গেল, কেউ এখনো বুঝতে পারছে না। তবে এটা বোঝা যায়, পূর্বতন সরকারের বিরুদ্ধে আমজনতার ভিষণ ক্ষোভ ছিল। এরই প্রেক্ষাপটে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে তার সামনে অনেক কাজ। মূল্যস্ফীতি রোধ, ঘুষ-দুর্নীতি রোধ, অর্থ পাচার বন্ধ করা, ব্যাংকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা থেকে শুরু করে অনেক কাজ।
বস্তুত, দেশ পরিচালনায় যখন যে সরকারই আসে, তখন তাদের অনেক চ্যালেঞ্জ থাকে। সেই প্রেক্ষিতে এই অন্তর্বর্তী সরকারেরও আছে; বরং একটু বেশি। কারণ রাষ্ট্র ও সমাজে দীর্ঘকাল ধরে ওঠা জঞ্জালগুলো সাফ করতে হবে, যাকে রাষ্ট্র সংস্কারও বলা যেতে পারে। এটিই হবে অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। একইভাবে দেশের জন্য তাদের অনেক কিছু অর্জন করারও আছে। জঞ্জালগুলো সাফ না করে সেই অর্জন কখনো সম্ভব হবে না। রাষ্ট্রের সংস্কারের সেই পদক্ষেপগুলো হলো-তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, গণভোট, না-ভোট পুনঃপ্রবর্তন করা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, পুলিশের বিশেষ ক্ষমতা বা সন্দেহমূলক আইনসহ বিভিন্ন কালো আইন বাতিল করা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, সড়কপথে শৃঙ্খলা আনা, শিক্ষাঙ্গনে লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি চিরতরে বন্ধ করা, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ চালু করা, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি পরিহার করা, দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনা, বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড চিরতরে বন্ধ করা, প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমা হ্রাস করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেকার ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, কর কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন, ভোক্তা অধিকার কমিশন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে পুনগর্ঠন করা, উন্নত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা, চাঁদাবাজী ও ব্যবসায় সিন্ডিকেট বন্ধ করা, বেদখল হওয়া সরকারি খাসজমি ও জলাশয় উদ্ধার করা, নিরাপদ সড়ক আইন বাস্তবায়ন করা, সরকারি ও সাংবিধানীক প্রতিষ্ঠানে সৎ-যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে নিয়োগ করা, বিদ্যমান শিক্ষাক্রম বাতিল করা, ব্যাংকঋণের বিষয়ে অনুসন্ধান ও নিয়ম ভঙ্গ করে ঋণগ্রহীতাদের বিচার করা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করা, জুলাই হত্যাকান্ডের দায়ীদের বিচারের জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতায় তদন্ত কমিটি ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা, কোটা আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, সম্প্রতিক সময়ে করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা বাতিল করা এবং ছাত্রদের নয় দফা দাবি দ্রুত বাস্তবায়ন করা। অর্থনীতিবিদদের মতে, গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে লোপাট হয়েছে, প্রায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা!! এই লুন্ঠিত টাকা উদ্ধারের যথাযথ ব্যবস্থা করা ও দায়ীদেরকে আইনের আওতায় আনা।
অন্তর্বর্তী সরকার যদি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা মহলের চাপে নতিস্বীকার করে এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন না করে শুধু দ্রুত নির্বাচন পরিচালনা করার দায়িত্বে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে দেশের রাজনৈতিক ধরন, আচরণ ও রীতিনীতিতে উল্লেখযোগ্য তেমন পরিবর্তন হবে না এবং আমজনতার আশা পূরণ হওয়ার সুযোগও আর কখনো পাওয়া যাবে না!! তড়িঘড়ি নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু ক্ষমতা পালাবদল হবে, দেয়ালে কার ছবি থাকবে সেটির বদল হবে, যারা আগে নির্যাতিত ছিল তারা নির্যাতনকারীতে পরিণত হবে, তাতে সাধারণ মানুষের ভাগ্য অপরিবর্তিতই থেকে যাবে। নিঃসন্দেহে সাধারণ জনতা এবং গণ-অভ্যূত্থানে অংশগ্রহণকারী কেউ সেটি চাইবে না। সুতরাং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তা বুঝতে হবে।
সুতরাং এই সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। বলা হচ্ছে, এবারের ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থান এই জনপদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা আর একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ হলো প্রথম স্বাধীনতা। আরো বলা হচ্ছে, প্রথম স্বাধীনতায় দেশবাসীর যেসব স্বপ্ন অপূর্ণ রয়েছে, দ্বিতীয় স্বাধীনতায় সেগুলো পূর্ণ হবে। নবীব-প্রবীণের সমন্বয়ে যে উপদেষ্টা পরিষদ বা সরকার গঠিত হয়েছে, সেই সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নিশ্চয়ই থাকবে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ।
আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে যুগে যুগের অভিজ্ঞতা হলো, প্রচলিত ধারার কোনো রাজনৈতিক দল বা শক্তি কখনো রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্কার করে সামজ ও রাষ্ট্রের কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন করে না। শাসনের সুবিধার্থে প্রচলিত কাঠামো-ই অটুট রাখতে চায়। তারপরও তারা যেটুকু করে তা একপেশে, নিজের গা বাঁচিয়ে করে। তাতে রাষ্ট্রব্যবস্থা কিংবা দেশের কোনো লাভ হয় না। আর এ জন্যই অন্তবর্তী সরকারের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেক বেশি। তবে সেই প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য প্রচুর সময় দরকার। কাজেই সাধারণভাবে অন্তবর্তী সরকার বলতে যেমন ধারণা করা হয় যে স্বল্পকালীন কয়েক মাসের একটি সরকার, যার প্রধান দায়িত্ব একটি সুষ্ঠু নিবার্চন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেওয়া, কিন্তু এবার তেমন হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। মানুষের দীর্ঘদিনের আশা ও স্বপ্ন অপূর্ণ-ই থেকে যাবে, যা আর কখনো পূরণ হবে না। দুঃখজনক হলেও সত্যিই যে আবার সেই পুরোনো ধারাই বহাল হবে এবং চালু থাকবে। তাই জনগণের বৃহৎত্তর স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকালটা যত দীর্ঘ হবে, ততই ভালো ও মঙ্গলজনক।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা সরকার কোনো ভালো কাজ যে কেরেনি তা কিন্তু নয়। এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীর টানেল, ফ্লাইওভারসহ বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরির্বতন না করে, শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নই একটি জাতিকে তুষ্ট করার জন্য যথেষ্ট নয়। মানুষ খাওয়া-পরার পাশাপাশি কথা বলার অধিকার চায়, ভোট দেওয়ার অধিকার চায় ও আদালতে ন্যায় বিচার চায়। এই গুলো হলো গণতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ। যে যত সাফাই গাক না কেন, এটা স্বীকার করতেই হবে যে শেখ হাসিনার পুরো আমলে বাংলাদেশে আক্ষরিক অর্থে গণতন্ত্র ছিল না। আর যেটা ছিল, তা হলো গণতন্ত্রের রেপ্লিকা।
মূলত দেশের গণতন্ত্রহীনতাই মানুষকে শেখ হাসিনার ওপর তীব্রভাবে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গত ৫ আগস্টের ঘটনায়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ক্ষোভ জীবন্ত আগ্নেয়গিরি মতো সুপ্ত ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে নির্বিচারে ছাত্র-জনতাকে হত্যার ঘটনায় সে আগ্নেয়গিরি লাভা উদগীরণ করে সবকিছু ভস্মীভূত করে দিয়েছে।
আমরা আশা করছি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন ও দেশের বিদ্যমান আইন সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার কাজে নতুন সরকার সফল হবেন।
আমরা জানি, এত দিন যে স্বৈরতান্ত্রিক ধারায় দেশ চলে আসছিল, তার বদলে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার কাজটি অত্যন্ত কঠিন। তবে অকস্মাৎ গণ-অভ্যূত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে দেশের সামনে পুরোনো রাজনৈতিক রীতিনীতি ও বিদ্যমান আইন-কানুন সংস্কারের এক অপূর্ব সুযোগ এসেছে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, নোবেল বিজয়ী অর্থনীবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত নতুন অন্তর্বর্তী সরকার তাঁদের ওপর অর্পিত এই কঠিন দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে এবং পুরোনো নষ্ট রাজনৈতিক ধারা পেছনে ফেলে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গঠনের দিকে এগিয়ে যাবে।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized