প্রায় ১৬ বছর পর গণ-অভ্যূত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে, ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাব উদ্দীনের নিকট হস্তান্তর করে দেশ ত্যাগ করেছেন তিনি। এই অভ্যূত্থানে প্রায় এক হাজার লোক শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন অগণিত। এত অল্প সময়ে পূর্বে কোনো গণ-আন্দো লনে এত লোক মারা যায়নি। অনেকেই বলছেন যে, স্বৈরাচারী শাসক থেকে মুক্ত হলো বাংলাদেশ। মুক্তির আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকেই দাবি করছেন, এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। এই গণ-আন্দোলনের তিন দিন পর গত ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা মানুষকে আশার বানী শুনিয়েছন। সমগ্র জাতি এই সদ্য অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে চায়।
দুর্ভাগ্যবশত, অতীতে বাংলাদেশের জনগণের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই ভালো অভিজ্ঞতা নেই। গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনার সরকার যেমন দুর্নীতি ও নিপীড়নের নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, এর আগের নির্বাচিত বিএনপি সরকারের সময়েও প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ‘হাওয়া ভবনের ছায়া সরকার’, বিরোধী দলের জনসভায় সামরিক গ্রেনেড হামলা, কুখ্যাত ‘জর্জ মিয়া’ নাটক, দেশব্যাপী জঙ্গি হামলার পৃষ্ঠপোষকতা স্মৃতিতে এখনো তাজা। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সামরিক বাহিনীর সহায়তায় সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করা হলে দুর্নীতির অভিযোগের ভয়ে অনেকেই তাদের বিলাসবহুল গাড়ি রাস্তায় ফেলে যাচ্ছিলেন। ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি-‘যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ’। যখনই যে দল ক্ষমতায় গেছে, তারা তাদের পূর্বসূরিদের ভুলের পুনরাবৃত্তিই শুধু করেনি, বরং মাত্রায় তাদের ছাড়িয়ে গেছে। জনগণ ভবিষ্যতে এ রকম পরিস্থিতি পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না।
লক্ষণীয়, প্রতিবারই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় রক্তাপাতের ঘটনা ঘটে। ক্ষমতার পালাবদলের সময় এভাবে যদি প্রচুর জানমালের ক্ষতি অব্যাহত থাকে, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা পৃথিবীর বুকে কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না, বার বার পিছিয়ে পববো। কোনো দলের বা গোষ্ঠীর কেউ কোনো অপরাধ করে থাকলে , দেশের প্রচলীত আইন অনুযায়ি তাদের বিচার হতে পারে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি সম্পদ ও স্থাপনা ধ্বংস করতে হবে কেন? এধরনের প্রবণতা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতোই বোকামির কাজ। এছাড়া এটা মানবতা বিরোধী অপরাধও বটে। সুতরাং এই পরশ্রীকাতরতা থেকে পরিত্রানের জন্য আমাদেরকে রাষ্ট্রের কাঠামোগত ও মানুষের বদলা নেওয়ার মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে।
বস্তুত, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরই চারদিকে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিকব্যবস্থা সংস্কারের দাবি উঠেছে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় যেখানে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ আছে সেখানে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সাম্য ও মানবিক মর্যাদার একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টাদের বক্তব্য-বিবৃতি থেকে জানা যাচ্ছে-তারাও বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার করতে চান। দিনবদলের প্রেক্ষিতে নতুন বাংলাদেশ বির্ণিমানের লক্ষ্যে কাজ করতে চান। কিন্তু এটা করতে হলে সর্বাগ্রে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেকে বদলাতে হবে। প্রতিহিংসা কিংবা প্রতিপক্ষকে নিশ্চহৃ করার রাজনীতি আর দেখতে চায় না দেশের আপামর জনগণ। হাসিনা সরকারের পতনের পর পর প্রতিহিংসামূলক আচরণ প্রতিরোধ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ার প্রেক্ষিতে সারা দেশে অনেক অনাকাংখিত ঘটনা ঘটেছে। সরকার পতনের পর অতি উৎসাহী কিছু উগ্রবাদী লোকের দ্বারা বিরোধীপক্ষের লোকদের স্থাপনা ভাঙ্গচুর হয়েছে, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ হয়েছে ও বেশকিছু জীবনহানীর ঘটনাও ঘটেছে-এগুলোর কোনো প্রয়োজন ছিল না।
আওয়ামী লীগ করে বলে তাদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে আগুন দিতে হবে, তাদেরকে নির্যাতন করতে হবে এবং এলাকা ছাড়া করতে হবে-এটাতো কোনো সুস্থ রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। অবশ্য বিএনপি, জামায়াত ও সমন্বয়কারীদের নিষেধ সত্ত্বেও এসব ঘটনা ঘটেছে। তবে পতিত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাদের বিভিন্ন ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতির কারণে কিছু সুবিধাবাদী ও উগ্রবাদীরা অতি উৎসাহী হয়ে এসব কেরেছে। অবশ্যই তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে দেশে কখনো প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ হবে না।
মূলত সংসদে গিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা কখনো দেশ ও জনগণের কথা বলেন না বা কাজ করেন না। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। লুটপাটের এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে চলে এসেছে। তবে তা এখন নতুন মাত্রা লাভ করেছে। এখন দুর্নীতির দুবৃর্ত্তায়ন ঘটতে থাকে কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত। ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো পূর্ববর্তী সরকারের অপকর্মের ফিরিস্তি প্রকাশ করে আর তলে তলে নিজেরা আরো অপকর্ম করতে থাকে। সর্বশেষে আওয়ামী লীগ সরকারের একটানা ১৬ বছরের শাসনামলের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের এক ভয়াবহ চিত্র জাতি আজ দেখতে পাচ্ছে এবং বহির্বিশ্বও তা দেখছে।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হলো রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার বাইরে থাকলে সাচ্চা গণতান্ত্রিক হয়ে যায়, গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করে। বাকস্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ অনেক কথাই বলে। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর এসব কথা বেমালুম ভুলে যায়। পতিত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার আবারও তা প্রমাণ করলো।
এই ক্রান্তিকালে সাধারণ মানুষের মনে একটি আশঙ্কা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, পরর্বতীতে যারা ক্ষমতায় আসবে তারাও পূর্ববর্তীদের মতো নিজেদের আখের গোছাবে। মানুষের মনের এই বদ্ধমূল ধারণা ভেঙ্গে দেওয়াটা খুবই জরুরি। এজন্য ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসার প্রত্যাশা করছেন তাদেরকে পতিত স্বৈরাচারী সরকার থেকে শিক্ষা নিয়ে বদলে যেতে হবে। প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
বর্তমানে এক জটিল পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। এই অবস্থায় সরকারের প্রথম কাজ হচ্ছে, আগের সরকারের অর্থনৈতিক লুন্ঠন ও রাজনৈতিক নিপীড়ন নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। জুলাই হত্যাকান্ডসহ অন্যান্য নিপীড়নের জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচারের সম্মু্খীন করা তাদের অন্যতম দায়িত্ব। তাদের আরো দায়িত্ব হলো, ব্যাংকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা দখল ও লুন্ঠন করেছে, তাদের কাছ থেকে সেই সম্পদগুলো উদ্ধার করা।
এই সরকার এক সময় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের নিকট ক্ষমতা তুলে দিবে। তাই ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন থেকেই জনবান্ধব হয়ে উঠতে হবে। পতিত স্বৈরাচারী সরকারের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা ইতিবাচক নয়। একাব্বই পরর্বতী সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঘুরেফিরে ক্ষমতায় থেকেছে। দু’দলই দুর্নীতি ও লুটপাট করেছে। নিলজ্জভাবে প্রশাসনসহ সাংবিধানীক প্রতিষ্ঠান গুলোকে দলীয়করণ করেছে। সাধারণ মানুষ এদের কাউকেই পছন্দ করে না। কিন্তু উপযুক্ত বিকল্প দল না থাকার কারণে এরাই ঘুরেফিরে ক্ষমতায় এসেছে এবং ভবিষ্যতেও আসবে।
বর্তমানে আন্দোলনকারীদের চাপে কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্দেশে গণহারে সারকারি ও সাংবিধানীক দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা পদত্যাগ করছেন কিংবা অপসারিত হচ্ছেন। ধারণা করা হচ্ছে, তারা সবাই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন। একটি বড়ো অংশের ক্ষেত্রে একথা সত্য হলেও তাদের মধ্যে হয়তো কেউ কেউ সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ লোকও থাকতে পারেন। এবিষয়ে বিশেষ সর্তকতা অবল্বন করা জরুরি। আবার যাদেরকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তারাও যেন সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ হন সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
উল্লেখ্য, কে কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন; কার মালিক ‘স্বৈরাচারের দোসর’ ছিলেন-এসব দিয়ে ব্যক্তির পরিচয় কিংবা ব্যক্তির ভূমিকা নির্ণয়ের কোনো সুযোগ নেই। কারণ, যারা চাকরি করেন, তারা শ্রমের বিনিময়ে পারিশ্রমিক নেন। যারা চাকরি করেন, তারা আজ এখানে তো কাল আরেক প্রতিষ্ঠানে। অতএব, ব্যক্তি হিসেবে তিনি নিজে যদি অসৎ, দুর্নীতিবাজ কিংবা দেশের জন্য ক্ষতিকর না হন, তাহলে তাকে তার প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রতিষ্ঠানের মালিকের পরিচয়ের কারণে ভিকটিম করা বা তাকে টাগের্ট করা অনুচিত।
সুতরাং দলীয় বিবেচনায় একজনকে অপসারন করে সেই একই দলীয় বিবেচনায় আরেক জনকে নিয়োগ দেওয়া হলে, ‘যেই লাউ সেই কদু’ দশা হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র সংস্কারের মহান চিন্তার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। যারা মনে করেন, এতদিন বঞ্চিত ছিলাম, এখন সবকিছু দখল করবো-তাদের দিয়ে কখনো কিছু ভালো আশা করা যায় না। আবার যারা মনে করেন, এতদিন নিপীড়ন-নির্যাতন ভোগ করেছি, এখন সবকিছুর প্রতিশোধ নেব-তাদের দ্বারা রাষ্ট্রব্যবস্থার গুণগত পরির্বতন ঘটানো সম্ভব নয়। তবে যারা হিংসা-প্রতিশোধ, লোভ-লালসার মানসিকতা পরিত্যাগ করে এবং জনপ্রত্যাশা বিবেচনায় নিয়ে নিজেকেই পরির্বতন করে নিতে পারবে-ভবিষ্যতের বাংলাদেশ তাদের নিকটই নিরাপদ থাকবে এবং তাদের দ্বারাই দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
খায়রুল আকরাম খান