মব (Mob) অর্থ উচ্ছৃঙ্খল জনতা ও জাস্টিস(Justice) অর্থ বিচার। ‘মব জাস্টিস’ অর্থ উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার। সাধারণত কোনো অপরাধ বা অপরাধীকে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় বিচার না করে উত্তেজিত জনতা নিজেরাই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যে শাস্তি প্রদান করে বা শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে তাকেই ‘মব জাস্টিস’ বা ‘মব লিঞ্চিং’ বলা হয়। আর আমাদের দেশে মব জাস্টিসকে বলা হয় ‘গণপিটুনি’ বা ‘গণধোলাই’।
মব জাস্টিসের সময় অনেক ক্ষেত্রে সত্য ঘটনা ও গুজবের মধ্যে পার্থক্য বোঝা যায় না। মিথ্যা অভিযোগে বা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নিরীহ ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা হামলার শিকার হতে পারে। উত্তেজিত জনতা প্রায়ই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সহিংস হয়ে ওঠে। মারধর, শারীরিক নির্যাতন এবং এমনকি অনেক সময় হত্যার ঘটনাও ঘটে।
আইনের দৃষ্টিতে, কোনো কারণে দুর্ঘটনা বা কোনো অপরাধের ঘটনায় প্রতিবাদ চলতে পারে, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরোধ হতে পারে। তবে কথিত অপরাধীর ওপর চড়াও হওয়াটা অপরাধ। আর তিনি যদি মারাত্মক আহত হন সেটা ফৌজদারি অপরাধ বা নির্যাতনের কারণে মারা গেলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড। এধরনের নির্যাতন বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড কোনোভাবেই সমর্থযোগ্য নয়।
আমাদের সমাজে অনেক বড় বড় অন্যায় হচ্ছে, অর্থপাচার হচ্ছে এবং খুন-গুম-ধর্ষণ হচ্ছে। তবে তার কোনো বিচার হচ্ছে না। তা নিয়ে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো প্রতিবাদও নেই। কিন্তু ছোটখাটো অপরাধের অভিযোগে বা অভিযোগ তুলে মানুষকে হেনস্তা করা হচ্ছে এবং এমনকি অনেক সময় পিটিয়েও মারা হচ্ছে। ব্যাপারটি খুব বিস্ময়করও বটে! এব্যাপারে মনোবিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা হলো, ‘অবদমিত মানুষ যেখানে পারছে তার ক্ষোভ প্রকাশ করছে। যেখানে ক্ষোভ উগড়ে দিলেও তার ক্ষতি হবে না সেখানে সে মবের অংশ হচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের ধারণা অনেক মানুষের মাঝে তাকে চিহিৃত করা যাবে না। তবে সবটাই মানুষের মানসিক, সামাজিক, আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থার প্রতিফলন’।
মব জাস্টিস একটি গুরুতর অপরাধ ও মানবাধিকার পরিপন্থি কাজ। দুঃখজনক বিষয় হলো, আমাদের দেশে মব জাস্টিস প্রায়ই দেখা যায়। উল্লেখ্য, ২০০৩ সালের প্রথমদিকে বিকাল বেলায় রাজধানীর পান্থপথ মোড়ে ছিনতাইকারী সন্দেহে তিন যুবককে হাত-পা বেঁধে শত শত মানুষের সামনে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য! চারপাশে তখন রীতিমতো জটলা বেঁধে যায়। কেউ কেউ হাততালিও দিচ্ছিলেন! দর্শক সারিতে ২/৩ জন পুলিশ সদস্যও ছিলেন। গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানো, তারপর দগ্ধ ব্যক্তিদের আর্তচিৎকার এবং শেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তারা।
২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবেবরাতে সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামের ‘কেবলাচরে’ ঘুরতে যায় সাত বন্ধু। ওই সময় ডাকাত সন্দেহে তাদেরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তবে তাদের মধ্যে ভাগ্যচক্রে আল-আমিন নামে একজন বেঁচে যান। অবাক হওয়ার বিষয়, নিহতরা সাবাই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী!
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর সকালদিকে সরকার বিরোধী আন্দোলন চলাকালে হরতাল ভঙ্গের কারণে ২০/২৫ জন ছাত্রলীগ কর্মী বিশ্বজিৎ দাস নামে এক দর্জী দোকানের কর্মচারীকে প্রকাশ্যে দিবালোকে শত শত মানুষ ও আইনরক্ষা বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
২০১৮ সালের ১১ মার্চ মধ্যরাতে নোয়াখালীর হাতিয়ায় গণপিটুনিতে ডাকাত সন্দেহে চার যুবক নিহত হন। অথচ নিহতেরা সবাই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার্থী।
২০১৯ সালের ২১ জুলাই বিকাল দিকে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার বাসিন্দা ভ্যানচালক মিনু মিয়া কালিহাতীর সয়া হাটে মাছ ধরার জাল কিনতে যায়। এ সময় সেখানে উপস্থিত লোকজন ছেলেধরা সন্দেহে তাকে গণপিটুনি দেয়। অতঃপর আটদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মনু মিয়ার মৃত্যু হয়।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে ছাত্র শিবিরের কর্মী সন্দেহে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলের ভেতর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নিমর্মভাবে পিটিয়ে হত্যা করে।
২০২৪ সালের ৭ জুলাই বিকাল দিকে জকিগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আব্দুল মজিদ নামে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবক পাশের ইউনিয়নের পশ্চিমভাগ গ্রামে ঘুরাঘুরি করছিল। এ সময় স্থানীয়রা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী যুবকের কথায় অবস্থান না বুঝে বরং তাকে ছেলেধরা হিসেবে সন্দেহ করে স্থানীয়রা। সন্দেহের এক পর্যায়ে যুবককে গণপিটুনি দেয় তারা। এরপর স্থানীয়রা তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় পুলিশের হাতে তুলে দেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল থেকে পর্যন্ত বাংলাদেশে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন প্রায় ৮০০ জন আর ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে গণটিটুনিতে ১৭২ জন নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে আরো জানা যায়, ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর জুলাই পর্যন্ত গণপিটুনিতে সমস্ত বাংলাদেশে নিহত হয়েছে প্রায় ৩২ জন। আর এর মধ্যে ঢাকাতেই নিহত হয়েছে প্রায় ১৬ জন। তবে গণপিটুনির সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে ঢাকা বিভাগে। নিছক ডাকাত, ছেলেধরা ও চোর সন্দেহেত তাদের অনেককে নিমর্মভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এই পরিসংখ্যানটি থেকে মব জাস্টিসের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। (চলবে)।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চিফ : deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized