হাসিনার পতনে পর চারিদিকে কেমন জানি অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য নিয়ে সমালোচনায় মুখর সোম্যাল মিডিয়াগুলো। সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন বিএনপি নেত্রী ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। ২০১৮ সালের ভুয়া নির্বাচনে হাসিনা বিএনপিকে জাতীয় সংসদের ৫টি সিট ভিক্ষা দিয়েছিলেন। সে ভুয়া সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি হয়েছিলেন ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। অনেকদিন হাসিনার ঘি-মাখন খেয়েছেন তিনি! গুরুতর অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার দাবিতে ভুয়া সংসদের এমপি পদ থেকে পদত্যাগ করে মানির মান রক্ষা করেছেন! রুমিন ফারহানা একটি আলোচনায় বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনা এখনো প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ৫৭ (৩) ধারা বলছে তিনি তার উত্তরাধিকারীকে কার্যভার বুঝাইয়া দেওয়ার আগ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকিতে এই সংবিধানের কোন কিছুই তাকে বারিত করিবে না। তার মানে দাঁড়ায় এই সংবিধান যদি থাকে তাহলে হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী মানতে হবে। মাথাকে এদিক-সেদিক দুলিয়ে তিনি কথাগুলো বলেছেন। তার এ বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ শেখ পরিবারের অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে বেশ আনন্দ ভোগ করেছেন। ১ মাসের বেশি সময় ধরে রুমিন ফারহানার সে বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজ ফিডের শীর্ষস্থানে ছিল। কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট না থাকলে রুমিন ফারহানার বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করার কোনো দরকার ছিল না। তিনি দেশের সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘদিন যাবৎ নির্যাতিত-নিপীড়িত দল বিএনপি’র ভাইটাল পোস্টে আছেন। জানা যায় তিনি বিএনপি’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক। আগেই বলা হয়েছে যে, কোনোরকম মুখরক্ষার জন্য ২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর ভুয়া সংসদ থেকে তিনি পদত্যাগ করে মানির মান রক্ষা করেছেন! দুনিয়ার কোনো দেশে গণঅভ্যূত্থানের পর বিদ্যমান সংবিধান বহাল রাখা হয় না। হাসিনা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি ভুয়া নির্বাচন করেছেন। হাসিনার আমলে দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। সহজ ভাষায় বলা যায় হাসিনা তার চাকর-বাকরদের দিয়ে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে তামাশায় পরিণত করেছিলেন। ভুয়া নির্বাচনে গঠিত একটি সংসদ বহাল রেখে আরেকটি ভুয়া নির্বাচন করা হয়েছে। ৩০০ জন এমপি বহাল থাকা অবস্থায় আরো ৩০০ জন এমপি শপথ দিয়েছেন। মিস রুমিন ফারহানা দুনিয়ার কোনো দেশে এসব ঘটনা ঘটেছে এ নজীর দেখাতে পারবেন? ইন্ডিয়ার মদদ ও সংবিধানের দোহাই দিয়ে হাসিনা সাড়ে ১৫ বছর যাবৎ জগদ্দল পাথরের মত জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিলেন। এ বিষয়গুলো কি রুমির ফারহানা জানেন না? খুব ভাল করেই জানেন। জেনে শুনে তিনি এসব কথা কেন বলছেন? অনেকেই বলছেন জেনেশুনেই তিনি আওয়ামী লীগের পারপাস সার্ভ করছেন মাত্র। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি আওয়ামী লীগ নেত্রী অপু উকিলের বান্ধবী। অপু উকিল ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে সংরক্ষিত আসন থেকে সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি যুব মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। মার্চ ২০০৪ থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তার স্বামী অসীম কুমার উকিল আওয়ামী লীগ নেতা।
অসীম কুমার উকিল ভুয়া নির্বাচনের নেত্রকোণা-৩ আসনের এমপি । তিনি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক।
প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে অপসারণের বিষয়ে তিনি সংবিধানের দোহাই দিয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরে বলেছেন, প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করা হলে সাংবিধানিক সঙ্কট হবে। তার বক্তব্য বিএনপির দলীয় অবস্থান কিনা সেটা সঠিক ভাবে জানা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করা হলে সাংবিধানিক সঙ্কটের কথা বলেছেন। সালাউদ্দিন আহমেদ এখনো ট্রমা সিনড্রোমে আছেন। তার উচিত ছিল রাজনৈতিক বিষয়ে বক্তব্য না দিয়ে আরো কিছুদিন রেস্টে থাকা। সংবিধান নিয়ে করা বিএনপি নেতাদের এসব বক্তব্য যদি দলীয় হয়-সেটা হবে খুবই দুঃখজনক। তাদের এসব বক্তব্য দলীয় চেয়ারপার্সনের অতীতে করা বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরিত।
২০১১ সালের ১৩ জুলাই বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, যেদিন জনগণের সরকার ক্ষমতায় যাবে সেদিনই এ সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেয়া হবে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সালাহউদ্দিন আহমেদ, রুমিন ফারহানারা কি বিএনপি চেয়ারপার্সনের নীতিগত সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছেন না? বিগত সাড়ে ১৫ বছর যাবৎ বিএনপি’র মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি’র গুলিতে মারা গেছেন। তাদের স্বাভাবিক জীবন ছিল দুর্বিষহ। বলা যায় প্রত্যেক অ্যাকটিভ বিএনপি নেতা-কর্মীদের জন্য দেশটা ছিল জাহান্নাম। বাইরে এবং কারাগারে দেখেছি বিএনপি ও জামায়াতের সক্রিয় নেতা-কর্মীরা কি অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেছেন। অন্যদিকে রুমিন ফারহানারা টক-শোতে হাসিনাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী-মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলে মুখে খই ফুটিয়েছেন। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়েও রুমিন ফারহানা দ্বিমত পোষণ করেছেন। জনগণের চাপের মুখে সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে। এ বিষয়ে রুমিন ফারহানার সমস্যা কি? বিএনপি যদি গনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে পারে তাহলে না হয় ছাত্রলীগের নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে দেবে। ব্যাস হয়ে গেল। কথাটা বলতে খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু না বলে পারছি না যে, রুমিন ফারহানা যদি বিএনপি’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক হন-তাহলে তার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল। দায়িত্বগুলো কি তিনি সঠিক ভাবে পালন করেছিলেন?
২০১৫ সালের মার্চ মাসের ১০ তারিখ রাত সাড়ে ৯টার দিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে উত্তরার একটি বাসা থেকে বিএনপি’র বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে তুলে নিয়ে যায়।
বিস্তারিত নিচের লিঙ্কে পড়ুন।
https://www.jugantor.com/politics/865530
একই ভাবে ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে গুম হন সুখরঞ্জন বালি।
বিস্তারিত নিচের লিঙ্কে পড়ুন।
https://dainiknagarbarta.com/archives/6886
সোর্ড অফ অনার পুরস্কার পাওয়া সেনা অফিসার আবদুল্লাহিল আমান আযমী, লেফট্যানেন্ট কর্ণেল হাসিনুর রহমান, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মান কাদের চৌধুরী, জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আহমদ বিন কাশেম, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, কবি ফরহাদ মজহার, সাংবাদিক লুৎফর রহমান কাজল, আবু ত্বহা আদনানসহ আরো বহু মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়ান গোয়েন্দারা যৌথভাবে উপরোক্ত গুমের ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। এ গুলো জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরার মত গুরুতর অপরাধের ঘটনা। কিছু সুবিধাভোগী নেতার গাফিলতির কারণে এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে বিএনপি নেতৃত্ব চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোতে এসব ঘটনার নিউজ প্রকাশ হতো না। কারণ মিডিয়াগুলো পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের জীবন বাজি রেখে এসব গুম-অপহরণের ঘটনাগুলোর বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেন। দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্যই তারা কাজগুলো করেছেন। তাদের ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ ছিল না। এসব জন ও দেশহিতৈষী কাজ করতে গিয়ে তারা হামলা-মামলা, জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। তাদের পরিবার-পরিজনসহ নির্যাতিত হয়েছেন। বিএনপি নেতারা এতো অল্প সময়ে এসব ভুলে গিয়েছেন? জুলুম-নির্যাতনের শিকার হওয়াদের মধ্যে আমি একজন। বিগত সাড়ে ১৫ আমাদের স্বাভাবিক জীবন বলতে কিছুই ছিল না। সাড়ে ১৭ বছর যাবৎ আমরা কঠিন সংগ্রাম করেছি। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত নৈরাজ্য-অরাজকতার বিষয়ে যারা জোড়ালো লেখালেখি করেছিলেন তাদের মধ্যে এ অধম অন্যতম একজন। এ কারণে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় যাবার পর আওয়ামী লীগের গুন্ডা-পান্ডারা অসুস্থ অবস্থায় আমার ওপর পরপর দুইবার বর্বর হামলা করে। ২০১৮ সালের ভুয়া নির্বাচনের আগে আমাকে ডাকাতের মতো আটক করে ৩টি মামলায় জড়ানো হয়। এখনো সে মামলাগুলোর হাজিরা দিচ্ছি।
বিএনপি মহাসচিব থেকে শুরু করে অনেক নেতা হঠাৎ আওয়ামী প্রেমী হয়ে ওঠেছেন। বিএনপি নেতা-কর্মীরা বিগত সাড়ে ১৫ বছর যাবৎ সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আমি সবসময় মজলুম নেতা-কর্মীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। পুলিশের গুলিতে পঙ্গু হওয়া অনেক বিএনপি কর্মীর অসহায় চেহারা এখনো আমার চোঁখে ভেসে ওঠে। এর বিপরিত চিত্রও আমি প্রত্যক্ষ করেছি। কতিপয় বিএনপি নেতা আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করে বার বার আন্দোলনের বুকে ছুরিকাঘাত করেছেন। সেটা কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দলের কঠিন সময়ে নিজেদের জীবন বাজি রেখে অনেক নেতা-কর্মী আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দূর্বল অবস্থানের কারণে বার বার আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। আন্দোলনে নেতাদের ব্যর্থতায় বিরক্ত হয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি সরাসরি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভুয়া নির্বাচনের আগে আন্দোলনের রূপরেখা হিসেবে ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩ মার্চ অব ডেমোক্র্যাসি নামে সমাবেশের ডাক দেয়া হয়। সে সমাবেশে খালেদা জিয়ার বক্তৃতা করার কথা। এর আগেই ২৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে বেগম খালেদা জিয়ার রাজধানী ঢাকার গুলশানস্থ ফিরোজা বাসভবনের গেটের সামনে বালু ভর্তি পাঁচ-ছয়টি ট্রাক রেখে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সরকার। এ কারণে তিনি বাসা থেকে বের হতে পারেননি। হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ ভাল করেই জানতো যে, কতিপয় বিএনপি নেতাদেরকে ম্যানেজ করা যাবে। তবে খালেদা জিয়াকে ম্যানেজ করা অসম্ভব। এরপর সাজানো মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে বিএনপিকে শেষ করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে হাসিনা। আওয়ামী সরকারের সকলপ্রকার কূটচাল মোকাবেলা করতে বিএনপি নেতারা চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানে হাসিনার পতনের পর দীর্ঘদিন যাবৎ নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হওয়া বিএনপি নেতা-কর্মীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। বিএনপি দলীয় ভাবে এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিল না। তবে দীর্ঘদিন যাবৎ নির্যাতন-নিপীড়ন, হামলা-মামলার শিকার হওয়া মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা এ আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। কি দুর্ভাগ্য যে, নিজেদের অতীতের দূর্বলতাগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে দলকে শক্তিশালী করার কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। ১৮০ ডিগ্রি উল্টো দিকে ঘুরে গিয়ে বিএনপি নেতারা এখন হাসিনার সংবিধান রক্ষা ও আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের প্রজেক্টের অংশীদার হয়ে ওঠেছেন। তারা অনেকটা অবোধ শিশুদের মতো খেল-তামাশা করছেন। এটা বিস্ময়কর! প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার তমিজ উদ্দিন বলেছিলেন, সংবিধান এখন আর সংবিধান নেই-এটা এখন হাসিনা বিধান। সে হাসিনা বিধানকে রক্ষায় কেন বিএনপি নেতারা এগিয়ে এসেছেন-সেটা তারাই ভাল বলতে পারবেন। হাসিনা পুত্র জয় বলেছিলেন, বিএনপি’র তার দলের বিরোধ মিটিয়ে ফেলা উচিত।
বিগত ২২ সেপ্টেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাথে সাক্ষাৎ করেন ইন্ডিয়ান হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা। প্রণয় ভার্মা একজন অ্যাডিশনাল সেক্রেটারী লেভেলের অফিসার। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভিপিআই পদমর্যাদার সাবেক মন্ত্রী। প্রটোকল ভেঙ্গেই ২২ সেপ্টেম্বর বিকেলে ইন্ডিয়ান হাই কমিশনার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এসে বিএনপি মহাসচিবের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
এসময় বিএনপি মহাসচিবের সাথে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ। অন্য দিকে হাই কমিশনারের সাথে ছিলেন উপ-হাইকমিশনার প্রভন বাধে। প্রায় ঘন্টাব্যাপী এ বৈঠকে দুই দেশের মধ্য দ্বি-পাক্ষিক উন্নয়ন, বিভিন্ন সমস্যাবলী নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক আরও কিভাবে গভীর করা যায়, দৃঢ় করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের সাথে ইন্ডিয়ার যে সমস্যাগুলো রয়েছে আমরা সেগুলো তুলে ধরেছি। আমরা আমাদের পানি সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়া দরকার সে কথা বলেছি। সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা প্রয়োজন সে কথাগুলো বলেছি। সে সাথে সিকিউরিটির যে বিষয়টা আছে সেটাও নিয়ে কথা বলেছি।
তিনি বলেন, (ইন্ডিয়ান হাইকমিশনার) বলেছেন যে তারা এ বিষয়গুলোতে সজাগ। তারা চেষ্টা করছেন দ্রুততার সাথে সে সমস্যাগুলো কিভাবে সমাধান করা যায়। তাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চান। বিশেষ করে এ পরিবর্তনের পরে (ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ক্ষমতার পরিবর্তন) নতুন যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আছে তাদের সাথে তারা ইতোমধ্যে যোগাযোগ করেছেন, কথা বলেছেন। বিএনপি ও দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্ক দৃঢ় করতে চান। এ সম্পর্কের মধ্যে কি করে আরও সুস্থতা, আরো পজেটিভিটি নিয়ে আসা যায় সেটা নিয়ে তারা কাজ করতে আগ্রহী। সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সবই গতানুগতিক কথা। এ আলোচনায় নতুন কিছুই ছিল না। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইন্ডিয়ান হাইকমিশনার তার দেশের ভৃত্য আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে বিএনপি’র সহায়তা চান। এ বৈঠকের পরই বিএনপি মহাসচিবসহ কয়েক জন নেতার বক্তব্যের সুর পাল্টে যায়। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসলেও তাদের আপত্তি নেই এমন বক্তব্য জোড়ালো হতে থাকে।
এটা স্পষ্ট যে, ইন্ডিয়া বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে ফাটল ধরিয়ে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। এ ফাঁদেই পা দিয়েছে বিএনপি’র কতিপয় নেতা। গত ৫ অগাস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর তারেক রহমান ছাড়া আর কোনো বিএনপি নেতা গণঅভ্যূত্থানের স্প্রীরিটের পক্ষে কথা বলেননি। হাসিনার পতনের পর বিএনপি নেতাদের উচিত ছিল নিম্নোক্ত বিষয়ে সরকারের কাছে জোড়ালো দাবি করা। (১) খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, বিএনপি’র মাঠ পর্যায়ের নেতাদের মাথার ওপর ঝুলতে থাকা লাখ লাখ গায়েবি মামলা প্রত্যাহার (২) ৬ শতাধিক গুম ব্যক্তির সন্ধান। (৩) সাজার মেয়াদ শেষ হবার পরও কারাগারে মানবেতন জীবনযাপন করা বিডিআর জওয়ানদের মুক্তি। (৪) রাজনৈতিক মামলায় আটক সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মুক্তি। (৫) ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি। (৬) সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের নামে দায়েরকৃত হয়রানী মূলক মামলা প্রত্যাহার। (৭) গুম, খুন ও গুরুতর অপরাধে জড়িত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সকল সদস্যদের আটক। (৮) বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার জড়িত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের আটক করা। অথচ এসব বিষয়ে মহাসচিব ও অন্যান্য নেতারা একদম উদাসীন রয়েছেন।
বিএনপি নেতারা নিয়মিতই নির্বাচনের দাবি করছেন। বিদ্যমান ভোটার তালিকা গোজামিলে ভরা। ভোটার তালিকায় ৯০ ভাগ নাম ও এনআইডিতে ভুল। এক ব্যক্তির একাধিক স্থানে ভোটার হবার ঘটনাও অসংখ্য। ভোটার তালিকার মৌলিক সংশোধন ও হালনাগাদ করা খুবই জরুরি। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ কোনো রদবদল এবং পরিবর্তন হয়নি। এ অবস্থায় কিভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে? এসব জনগুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়ে বিএনপি নেতাদের কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। তারা শুধু দ্রুত নির্বাচন, সংবিধান সংরক্ষণ ও আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আওয়ামী লীগের মতো তারা এখন ৭১ নিয়ে নতুন করে রাজনীতি শুরু করেছেন। এটা বিস্ময়কর বটে! বিএনপি নেতারা ভুলে যাচ্ছেন যে, দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বীর উত্তম খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। তিনি কখনো মুক্তিযুদ্ধে নিজের ক্রেডিট দাবি এবং এ বিষয়ে নোংরা রাজনীতি করেননি।
এসব কথা লিখলে অনেকেই আমাকে জামায়াতে ইসলামীর দালাল বলবে। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই আমি কোনো রাজনৈতিক দলের দালাল নই। আমি বাংলাদেশ ও এ দেশের নিপীড়িত ও অসহায় মানুষের দালাল। কে কি বললো না বললো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। ১/১১ সরকারের আমল থেকে বিগত সাড়ে ১৭ বছর যাবৎ আমিসহ অনেক দেশপ্রেমিক সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী নিরলস ভাবে কঠিন সংগ্রাম করে যাচ্ছি। বিগত ৫ অগাস্ট আমাদের প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়েছে।
সমস্যা হলো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতারা সামনের দিকে না তাকিয়ে কেন যে পেছন দিকে চলে যাচ্ছেন-সেটা তারাই ভাল জানেন। আওয়ামী লীগ যদি নিজেদের অপকর্মের কারণে রাজনীতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় সেক্ষেত্রে বিএনপি বা অন্যান্য দল কি করতে পারবে? এক সময় ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্টে মুসলিম লীগ সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল ছিল। সে দলের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল। সে মুসলিম লীগ নিজেদের কৃতকর্মের জন্য এদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিএনপি নেতাদের মধ্যে আওয়ামী প্রেম জেগে ওঠার কারণ কি? এতোই যদি আওয়ামী প্রেম তাহলে আন্দোলন করে বিগত সাড়ে ১৫ বছর ধরে লাখ লাখ নেতা-কর্মীদের সাজানো মামলার জালে জড়ালেন কেন? হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেন কেন? অনেককে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিলেন কেন? প্রশ্নগুলো স্বাভাবিক ভাবেই সামনে আসবে। এ জন্যই বলি কথা বলার সময় চিন্তা-ভাবনা করে বলা উচিত। অপরিণামদর্শি বক্তব্য-বিবৃতির কারণে নিজেদেরই কুপোকাত হতে হবে। আওয়ামী দুঃশাসন-কুশাসনে রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন, হামলা-মামলা ও দেশের স্বার্থ বিরোধী চুক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদেরও খোঁচা মেরে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব। জামায়াতের সাথেও বিরোধে জড়াচ্ছেন কতিপয় বিএনপি নেতা। বিএনপি একটি বড় ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। দলটি কি করবে না-করবে সেটা তাদের নিজস্ব বিষয়। তাতে আমাদের কিছুই বলার নেই।
তবে ইন্ডিয়ার সাথে তথাকথিত সম্পর্ক উন্নয়ন ও আওয়ামী লীগের সাথে অতি উদারতা প্রদর্শনের বিষয়ে আমাদের কিছু বক্তব্য আছে। বিএনপি নেতাদের বুঝতে হবে দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ওয়াকওভার ও পুনর্বাসনের কোনো অধিকার তাদের দেয়নি। বিএনপি নেতারা যদি আওয়ামী লীগকে ওয়াকওভার ও পুনর্বাসন করতে চান তাহলে নিম্নোক্ত সীমাহীন অপরাধের দায়ভার তাদের কাঁধে তুলে নিতে হবে। (১) সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসন-কুশাসন। (২) ৩টি ভুয়া নির্বাচন। (৩) সীমাহীন দূর্নীতি, লুটপাট। (৪) ২০ হাজারের বেশি খুন। (৫) ১ হাজারের বেশি মানুষকে গুম। (৬) শেয়ার বাজার লুট। (৭) ইন্ডিয়াকে অবাধে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর অনুমতি দেয়া। (৮) সাজানো মামলা দিয়ে বিরোধী নেতা-কর্মীদের জেল-জুলুম ও ঘর-বাড়ী ছাড়া করা । (৯) সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের নির্যাতন-নিপীড়ন। (১১) যুদ্ধাপরাদের বিচারের নামে সাজানো মামলায় জামায়াতে ইসলামী ৪ শীর্ষ নেতা ও বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসিতে ঝুলানো। (১১) বিগত জুলাই মাসের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যা।
ইন্ডিয়ার সাথে তথাকথিত সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে বলতে হয় যে, ইন্ডিয়ার সাথে সম্পর্ক হতে হবে সম অধিকার ও সম মর্যাদার ভিত্তিতে। যার ভিত্তি জিয়াউর রহমান তৈরী করে গিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের বাইরে গিয়ে বিএনপি যদি আওয়ামী লীগের পথেই হাটে তাহলে চরম মূল্য দিতে হবে। আরো একটি জরুরি কথা বলে রাখি, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন প্রজেক্টে যারা জড়িত আছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি আপনাদের কাউকে আমরা ছাড়ব না। তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন। কারণ রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক তৎপরতায় সম্পৃক্ত না হয়েও আমরা জেল-জুলুমের শিকার হয়েছি। আমাদের পরিবার-পরিজন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আমরা কেন জেল-জুলুমের শিকার হয়েছি সেটা নিশ্চয় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের অজানা নেই।
লেখক: গল্পকার, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
E-mail: s.iquram03@gmail.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized
লেখাটা শেয়ার করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ।