চরম আর্থিক সংকটের মুখে বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধে অপারগতার কথা জানাল দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলংকা। শ্রীলংকা `ঋনণখেলাপি` ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সে দেশের অর্থনৈতিক দেউলিয়া দশা ঘোষণা করল। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক ঋণ এবং সুদ মেটাতে অন্তত ৬৯০ কোটি মার্কিন ডলার প্রদানের কথা ছিল শ্রীলংকার। অথচ তাদের বর্তমান বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় মাত্র ২৩১ ডলারে এসে ঠেকেছে। অথচ এক সময় দেশটি একটি উচ্চ মধ্যম আয়ের রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ছিল। দেশটির সঙ্গে ইউরোপের অনেক দেশের তুলনা করা হতো। সেখানে শতভাগ মানুষ শিক্ষিত, নিষ্ঠাবান ও কঠোর পরিশ্রমী। এর ব্যবসা-বাণিজ্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও যথেষ্ট বিকাশ লাভ করেছিল। কিন্তু সেই দেশটি হঠাৎ করে একটি দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হবে, এটি কেউ ভাবতে পারেনি!
এখন দেশজুড়ে হাহাকার চলছে। শ্রীলংকায় দিনের অর্ধেক সময় লোডশেডিং, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে, পেট্রল পাম্পে তেল নেই, রান্নার গ্যাস নেই!
শ্রীলংকার বর্তমান শাসক রাজাপক্ষের পরিবার-যে পরিবারে এক ভাই দেশের রাষ্ট্রপতি, অন্য ভাই প্রধানমন্ত্রী, আরও দুইভাই এবং ছেলেমেয়েদের অধীনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব দপ্তর। সব মিলিয়ে দেশের বাজেটের প্রায় ৭০ শতাংশই তারা নিয়ন্ত্রণ করতো। অভিযোগ রয়েছে, তারা এই সুযোগে প্রচুর টাকা বিদেশে পাচার করেছে। আর তারা যে ভঙ্গিতে দেশ পরিচালানা করেছে, এটা তার প্রতিফলন ছিল। দেশ ও জনগণের কথা তারা কখনও ভাবেনি। আর এই স্বৈরাচারী পরিবারের হাত ধরেই শ্রীলংকায় তামিলদের পতন ঘটে ও সিংহলী বৌদ্ধ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের সব গুরুত্বপূর্ণ ভার চলে যায় সেই জনগোষ্ঠীর হাতে। প্রশাসনের উঁচু পদ থেকে পুলিশ-সেনাবাহিনী সর্বত্রই নিজেদের লোক।
পর্যটনের জন্য শ্রীলংকার বেশ খ্যাতি ছিল। এটা ছিল তাদের আয়ের অন্যতম উৎস। কিন্তু হায়! ২০১৯-এর এপ্রিলে কলম্বোর একাধিক চার্চে ও পাঁচতারা হোটেলে ধারাবাহিকভাবে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে প্রায় ২৫০ লোক মারা যান। আর এই বিস্ফোরণের ফলে এক ধাক্কায় কলম্বোয় বিদেশী পর্যটন ৭১ শতাংশ কমে যায়। ২০২০-এর অতিমারী পরিস্থিতি আরও জটিল করে দেয়। ২০১৮-তে পর্যটন খাতে শ্রীলংকার আয় হয়েছিল ৪৪০ কোটি ডলার। সেই শ্রীলংকায় ২০২০ সালে পর্যটন খাতে আয় হয়েছে মাত্র ৬ কোটি ৮২ লাখ মার্কিন ডলার এবং ২০২১-এ আয় হয়েছে ৫ কোটি ৩৪ লাখ মার্কিন ডলার!
এমন পরিস্থিতিতেই রাষ্ট্রপতি রাজাপক্ষে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ কমিয়ে ৮ শতাংশ করেন; পণ্য পরিসেবার ওপর যে ২ শতাংশ নেশন বিল্ডিং ট্যাক্স গ্রহন করা হতো, তা-ও তুলে দেন। শেয়ারবাজারের মূলধনী আয়ের ওপর করের হারও কমানো হয়। কিন্তু অভিজাত শ্রেণীর মুদ্রা পাচারের কারণে এই পদক্ষেপগুলো ভালো হলেও, হিতেরবিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। ফলে রাষ্ট্রপতির এই নতুন করনীতি রাজকোষে টান ফেলে। অন্যদিকে বিদেশি মুদ্রার সংকট আমদানিতে বেশ প্রভাব ফেলে। এই অবস্থায় আমদানি খরচ কমাতে গিয়ে রাজাপক্ষে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দ্রব্য আমদানি নিষিদ্ধ করে দেন। রাষ্ট্রপতির এ পদক্ষেপও পরিবেশবান্ধব ছিল। কিন্তু মানুষ ভাবে একটা, হয় আকেরটা। হঠাৎ জমিতে কৃত্রিম সারের পরিবর্তে জৈব সার প্রয়োগের ফলে উচ্চফলনশীল ফসলে বিরুপপ্রভাব পরে। কমে যায় চা-কফি, ধান-গম উৎপাদন। কৃষি উৎপাদনে এমন নাজুক পরিস্থিতির কারণে দেশে খাদ্য সংকট তৈরি হয়। এমতাবস্থায় বিশ্ববাজরে চাহিদা অনুযাীয় চা-কফি রপ্তানী করতে শ্রীলংকা সরকার ব্যর্থ হয়।
একদিকে খাদ্যসংকট, বাণিজ্য সংকট এবং অন্যদিকে মুদ্রা সংকট। আর মুদ্রা সংকটের কারণে সব ধরনের আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে দেশে পাওয়া যাচ্ছে না গুড়াদুধ, চিনি, নিউজপ্রিন্ট, ডিজেলসহ শিল্পজাত অন্যান্য পণ্য। নিউজপ্রিন্টের অভাবে খবরের কাগজ বের হচ্ছে না, প্রশ্ন ছাপা যাচ্ছে না বলে স্কুল-কলেজে পরীক্ষা বন্ধ হয়ে আছে। বিদ্যুৎ সংকট চরম অবস্থায়। রাস্তায় আলো জ্বলছে না, হাসপাতালে চিকিৎসা করা যাচ্ছে না; চলছে না এটিএম
মেশিন ও মোবাইল ফোন। সবক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর অবস্থা। গত ৭৫ বছরে এত দুর্দশা দেখেনি লঙ্কাবাসী!
মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০১০ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর মাত্রাতিরিক্ত বৈদেশিক ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কায় নানা ধরনের বড় বড় প্রকল্প গ্রহন করেন এবং তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেন। উল্লেখ্য, মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০০৫ সালে প্রথমবার রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর খুব কঠোরভাবে তামিল বিদ্রোহ দমন করেন এবং ওই বছরই সমুদ্রের দেশ শ্রীলংকাকে সিঙ্গাপুরের মতো সমুদ্রবন্দর করার লক্ষ্যেই চীনের সঙ্গে হাম্বানটোটা বন্দর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। প্রথম ধাপে খরচ হয়েছিল ৩৬০ মিলিয়ন ডলার। ২০১২ সালে এটির আয় হয় প্রায় ১১ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলার, কিন্তু এর প্রশাসনিক ব্যয় হয় প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার। এই বন্দর নির্মাণ সম্পন্ন ও পরিচালনা করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিকভাবে চরম সংকটে পড়ে। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে একটি চীনা কোম্পানীর নিকট ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিতে বাধ্য হয়। অনুরূপভাবে হাম্বানটোটা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ২০ কোটি ডলারে চীনা কোম্পানীর ঋণে বানানো হয়েছে রাজাপক্ষে আন্তজার্তিক বিমানবন্দর। তবে বর্তমানে শ্রীলংকা সরকার উক্ত বিমানবন্দরের বিদ্যুৎ বিল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
শ্রীলংকার রাজনৈতক অস্থিরতা অতীতের সব মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। সেখানে দীর্ঘদিন মানুষ রাস্তায় গোতাবায়া এবং মাহিন্দা সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। অবশেষে রাজনৈতিক চাপের মুখে চলিত বছরের ১২ মে মাহিন্দা রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কার প্রধান্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। অতঃপর তার স্থলাভিষিক্ত হন রনিল বিক্রমাসিংহ। এখন শ্রীলঙ্কার জনগণ রাষ্ট্রপতি পদত্যাগও দাবি করছেন। মহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগের পর সহিংসতা আরও বেড়ে গেছে। আন্দোলনকারীদের সহিংসতায় একজন সাংসদসহ মোট আটজন প্রাণ হারান। জনগণের এই সহিংস আন্দোলন দমনের জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশবাহিনীকে গুলি চালানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে!
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে টালমাটাল শ্রীলঙ্কার সরকারবিরোধী বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে গত ১২ জুলাই রাতের আধারে দেশ থেকে সামরিকবাহিনীর বিমানে মালদ্বীপে পালিয়ে যান রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষে। তারপর ১৪ জুলাই সিঙ্গাপুর পৌঁছেন এবং সেখান থেকে ওই দিনই তিনি নিজ দেশের স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনের নিকট ই-মেইলের মাধ্যমে তার পদত্যাগ পত্র পাঠিয়েছেন এবং তা গৃহীত হয়েছে। এমতাবস্থায় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমা সিংহে। এখন তার পদত্যাগের দাবিতেও বিক্ষোভ আরো জোরদার হচ্ছে। লাগাতার তিন মাসের গণ-আন্দোলনের মুখে দুইভাইয়ের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশটিতে দীর্ঘ ২০ বছরের রাজাপক্ষে পরিবারের ক্ষমতার অবসান হলো।
সময়ের স্বল্পতার কারণে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি নিবার্চনে ভোটের নিয়ম বদল হয়েছে। সাধারণ নাগরিকদের সমথর্নে নয়, দেশটির সংসদ সদস্যদের ভোটেই চলিত মাসের ২০ জুলাই নির্বাচিত হবেন রাষ্ট্রপতি। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, রাজাপক্ষের পরিবারের প্রতি অনুগত দল ` শ্রীলঙ্কান পদুজানা পেরামুনার` জাতিয় সংসদে সংখ্যাগনিষ্ঠতা রয়েছে। দৃশ্যত জনসমর্থন হারিয়ে টলমল করলেও তা নির্ণয়ে এই তাদের এই
দল বড় ভূমিকা রাখবে। ওদের চাল একটু এদিক-ওদিক হলেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে টালমাটাল শ্রীলঙ্কায় গণতন্ত্রের পরীক্ষা দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাবে!!
নিয়িতির কি নির্মমপরিহাস! শ্রীলঙ্কানদের মতো শিক্ষিত ও রুচিবান জাতি রাজনৈতিক নেতাদের অদূরর্দশিতার কারণে আজ রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সবদিকেই ঘাটতিতে পড়ে গিয়েছে। চীন হলো শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় দ্বিপাক্ষিক অংশীদার। তাদের কাছে শ্রীলঙ্কার ঋণের পরিমান ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এখানেই শেষ নয়। শ্রীলঙ্কার সব মিলিয়ে ঋণের পরিমান ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেই সঙ্গে ক্রমেই মুখ থুবরে পড়েছে জিডিপি। এসবেরই হাত ধরে আমজনতার ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। শ্রীলঙ্কার জনগণ তাদের রক্ষার আপাতত কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে দলে দলে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। শ্রীলঙ্কার এই দুঃসময়ে বড় দেশগুলো তার পাশে নেই বললেই চলে। এইদিকে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কোনো ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে।
বস্তুত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে বেশ ভিন্নতা রয়েছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বৈদেশিক ঋণ বহুপাক্ষিক সংস্থা ও দ্বিপাক্ষিক। এসব ঋণের ঝুঁকি কম, পরিশোধকাল দীর্ঘ। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার বেশিভাগ ঋণ বাণিজ্যিক ও সভরেন বন্ডের, যেগুলো উচ্চ সুদসহ ৫ বছরে পরিশোধ করতে হয়। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমান ৩৫ বিলিয়ন ডলার, অথচ দেশটিকে প্রতিবছর ঋণ পরিশোধ করতে হয় ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমান ৫০ বিলিয়ন ডলার। তবে তা শ্রীলঙ্কার তুলনায় বেশি হলেও প্রতিবছর উক্ত ঋণ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয় মাত্র ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কার ঋণের সুদহার ৮ শকাংশের বেশি। তবে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের সুদহার ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ঋণ পরিশোধের মেয়াদকাল ৩০ বছর। শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশে উচ্চ সুদের বাণিজ্যিক ঋণ ও সভরেন বন্ড নেই। এছাড়াও শ্রীলঙ্কা মতো বাংলাদেশে সিংহলী-তামিল দ্বন্দ্ব নেই। এসবদিক বিবেচনায় বাংলাদেশ কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। তারপরও বলবার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। এভাবে টাকা পচার হতে থাকলে শ্রীলঙ্কার মতো দেউলীয়া রাষ্ট্রে পরিণত হতে বাংলাদেশের বেশি সময় লাগবে না!
শ্রীলঙ্কার এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে আমাদের দেশের সাধারন জনগণসহ রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সমাজ গবেষকরা আতঙ্কিত! তারা সবাই গভীরভাবে শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতি নিয়ে ভাবছেন এবং নিজ নিজ অভিমত দিচ্ছেন। কেউ কেউ আলোচনার পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার অজ্ঞিতা থেকে বাকিদের শিক্ষণীয় কি হতে পারে তাও উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন। এই প্রসঙ্গে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড.মইনুল ইসলাম বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছেন, শ্রীলঙ্কার এই চলমান গণ-আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর অনেকগুলো শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। তিনি বলেছেন, নির্বাচিত সরকার হলেই খামখেয়ালি ও স্বেচ্ছাচারিতার লাইসেন্স জনগণ কাউকে দেয় না। বিদেশী ঋণ পাওয়া গেলেই যথার্থ প্রকল্প মূল্যায়ন ব্যতিরেকে কারও ইচ্ছামাফিক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিণাম কখনোই শুভ হয় না। শ্রীলঙ্কা হলো তার বাস্তব উদাহরন। বাংলাদেশেও প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে যদি শ্রীলঙ্কার মতো গ্ল্যামারাস ও স্বল্প-প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ অব্যাহত থাকে, তাহলে শ্রীলঙ্কার মতো ঋণগ্রস্তার ফাঁদে পড়তে বাংলাদেশেরও দেরি হবে না।
এই প্রসঙ্গে সহমত পোষন করে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, বাংলাদেশের সাথে শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতির তুলনা করে দেখার সময় এখনই এসেছে কিনা তা বলা যায় না। তবে দুর্নীতির ক্ষিপ্রতা ও সরকারি অব্যস্থাপনা থেকে রক্ষা না পেলে এবং বিদেশে অবাধে টাকার পাচার বন্ধ না হলে, আমরাও যে শ্রীলঙ্কার মতো অর্থ সংকটে পড়বো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতে আমাদানী-রপ্তানী ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি। আর এই মুদ্রাস্ফীতি শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করেছে। আমাদের দেশেও একই কারণে মুদ্রাস্ফীতি চলছে এবং আমদানি খরচ ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই সুযোগে কিছু কিছু আমদানিকারক ওভার ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে বিদেশে মুদ্রা পাচার করে দিচ্ছে। অসৎ ব্যবসায়ীদের এমন গর্হিত আচরণে প্রশ্ন আসে-আমরাও কি শ্রীলঙ্কার মতো ধ্বংসের পথে হাঁটছি? এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড.সেলিম রায়হান বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছেন, যে হারে আমদানী হচ্ছে, তাতে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে মুদ্রা পাচারের ঝুঁকি রয়েছে। সরকারকে এটা ঠেকানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যে হারে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানি হচ্ছে বলে আমরা দেখছি, এর প্রতিফলন তো আমরা বিনিয়োগে দেখছি না। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে, শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২০২২ সালের মে মাসে ৪১ বিলিয়ন ডলার হয়ে গেছে। চলমান মেগা-প্রজেক্টগুলোর ব্যয়ের ধারাবাহিকতায় বৈদেশিক ঋণ ৯১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে বাংলাদেশের আমদানি গত বছরের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেড়ে গেছে, যেটা আসন্ন মহাবিপদের `অশনিসংকেত` হিসেবে আখ্যায়িত করাই সমীচীন। এই গতিতে আমদানি এলসি খোলা অব্যাহত থাকলে ২০২২ সালের ৩০ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের মোট আমদানি ৮২-৮৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। এর মানে, এই অর্থবছরের রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর প্রাক্কলন সত্ত্বেও অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমান অর্থবছরে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাবে। অতএব, আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে এ বছর প্রায় ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। সুতরাং সময় থাকতে এখনই আমাদের সরকারকে সাবধান হতে হবে!
ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও জনবাদী বা জনকল্যাণমূকল রাজনীতি চালু আছে। এখন সময় এসেছে গভীরভাবে গবেষণা করা। কি কারণে এবং কোনো কোনো বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে শ্রীলঙ্কা আজ এমন একটি ভয়াবহ সংকটের পথে হাঁটছে, তা বিচার-বিশ্লেষণ এবং সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয়টি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবগুলো দেশেরই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে। যদি আমরা শ্রীলংকার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর পথে যথাযথভাবে হাঁটি, তাহলে আশা করা যায় তেমন কোনো সমস্যা হবে না। তবে এর ব্যত্যয় ঘটলে শ্রীলংকার মতো মন্দভাগ্য আমারদরকে বরণ করতে হবে।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন।
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized