চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি রাতে এক ‘বিশেষ’ নির্দেশে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ফলে এই নির্দেশনা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়ে গেছে। অবশ্য এর আগে ১ জানুয়ারি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির এনবিআরের প্রস্তাব পাস করা হয়। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়। জাতীয় সংসদ না থাকায় অধ্যাদেশ দিয়েই শুল্ক-কর বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এ ধরনের কর বৃদ্ধি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে তোলার মাধ্যমে এরই মধ্যে ব্যাপকমাত্রায় বিরাজমান ধনী-দরিদ্রের আয়বৈষম্যকে আরও ব্যাপকতর করে তোলে। ভ্যাটবৃদ্ধির ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়ার মাধ্যমে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। তাদের খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাব্যয় আরও কঠিন হয়ে ওঠে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা উচ্চভ্যাটের কারণে তাদের পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হন আর এর প্রভাব পড়ে তাদের বিক্রি-ভাট্টাতে। দ্রব্যের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই এর চাহিদা কমে। এর চাপ পড়ে ব্যবসায়ীর ওপর। বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তুলনামূলকভাবে এই চাপ সামাল দিতে পারলেও স্থানীয় ছোট ব্যবসায়-কাঠামো ভেঙ্গে পড়ার ঝুঁকিতে থাকে।
গবেষকদের অভিমত, এ ধরনের কর এমন এক সময় বাড়ানো হলো, যখন দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে শুধু নিম্ন ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ নয়, মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাচ্ছে। তাদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছ। এখন নতুন শুল্ক-কর আরোপের ফলে এই শ্রেণির মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে এসে এভাবে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর বিষয়ে অন্তর্বর্তীকলীন সরকারের লোকজন ও রাষ্ট্রপতি একমত হলেন কিভাবে- সেটাই আশ্চর্য হওয়ার মতো একটা বিষয়! অথচ রাজনৈতিকদল-বুদ্ধিজীবীমহল ও সাংস্কৃতিককর্মীদের এই বিষয়ে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া নেই-ব্যাপারটি খুবই দুঃখজনক বটে!
বস্তুত, আমাদের দেশে ক্ষমতায় যাওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলো পূর্ববর্তী সরকারের অপকর্মের ফিরিস্তি প্রকাশ করে ও জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাগবের কথা বলে, কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর তারা পূর্বের ওয়াদা সব ভুলে যায়। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলেছে, ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়লেও জিনিসপত্র দামের ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না, কিন্তু সরকারবাহাদুরের এধরনের বক্তব্য সঠিক নয়। সরকার রেস্তোরা, হোটেল, পোশাক, বিমান,এমনকি এলপিজি গ্যাস, রেস্তোরার খাবারসহ শতাধিক পণ্যের ওপর ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কর বৃদ্ধি করেছে, যা জাতির এই ক্রান্তিকালে কোনো প্রয়োজন ছিল না। যেমন সাবান, ঔষধ, আচার, বার্নিশ ও লেকার, ডিটারজেন্ট পাউডার, মোবাইল সেবা, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটসহ শতাধিক পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে দেশের মানুষের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসবে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এ ধরনের ভ্যাট-ট্যাক্স বৃদ্ধি করা ‘মরার উপর খাঁরার ঘা’এর মতো অবস্থা হবে। মানুষ তখন দুঃখ-হতাশায় চোখে শুধু ‘সষ্যের ফুল দেখবে’। এতে মূল্যস্ফীতি শুধু বাড়বে তা নয়, ক্ষু্দ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধের অবস্থাও হতে পারে। দুর্দশাগ্রস্ত গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর এধরনের ভ্যাট-ট্যাক্সের চাপ অমানবিক ও হতাশাজনক।
এ মুহূর্তে সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ভীষণ দুর্ভোগে পড়েছে। বাজারে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা শতভাগ রয়েছে। এমনিতে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় প্রায় ছয় মাস ব্যবসায় মন্দাভাব থাকায় অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মু্খীন হয়েছে। শিল্প-বাণিজ্যে ধস নেমে এসেছে। বিমানের টিকেটের মূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষ আর বিমান ভ্রমণে আগ্রহী হয়ে উঠবে না। তৈরি পোশাকের ব্যবসা আগের মতো নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বাড়তি আয় জনগণের জন্য অনেক কষ্টদায়ক, যা আগুনে ঘি ঢালার মতো। দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করার ব্যাপারে বর্তমানে অন্তর্বতীকালীন সরকারের যথেষ্ট অবরহেলা ও উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। উন্নয়নে বা সার্বিক কল্যাণে অর্থ ব্যয় না করে অনেক অপরিকল্পিতভাবে খরচ করা হচ্ছে, যা দেশ ও রাষ্ট্রের জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়।
অনেক গবেষকদের মতে, সরকার এভাবে ঢালাওভাবে শুল্ক কর না বাড়িয়ে সম্পত্তি কর বাড়লে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ অনেকটা কমবে। নানা রকম সম্পদের ওপর কর বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমন, একাধিক বাড়ি বা গাড়ি ক্ষেত্রে কর পুনবিন্যাস করা যেতে পারে। দু্র্নীতিবাজ যাদের সম্পদ জব্দ হয়েছে বা অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ হয়েছে সেগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও বিত্তশালী বা বড় ব্যবসায়ীরা নানা জাল-জালিয়াতের মধ্যমে প্রতি বছর কোটি কেটি টাকা বিদেশে পাচার করছে, সেসব টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিলাসী সামগ্রীর ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি করা যেতে পারে। ব্যাংক ঋণখেলাপীদের কাছ থেকে সুদসহ টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অবস্থাপন্নদেরকে করের আওতায় আনা যেতে পারে।
আমরা সবাই জানি, ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়লে সরকারের আয় বাড়বে ; কিন্তু তা হতে হবে যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত, সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ বৃদ্ধি করে নয়। সরকারের উচিত ব্যয় সংকোচন করা ও করফাঁকিবাজদের করের আওতায় আনা। আশা করছি, মানবিক দৃষ্টিতে বর্তমান ভ্যাট-ট্যাক্স বৃদ্ধির ব্যবস্থা থেকে সরকার জনস্বার্থে সরে আসবে অথবা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized