বস্তুত, লোহিত রক্তকণিকায় থাকা হিমোগ্লোবীন অক্সিজেন পরিবহন করে। এই হিমোগ্লোবীনের জন্য রক্ত লাল দেখায়। শ্বেত রক্তকণিকা রোগ জীবানু ধ্বংস করে এবং অনুচক্রিকা রক্ত জমাট বাধতে সাহায্য করে।
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের শরীরে ৫ লিটার এবং প্রাপ্ত বয়স্কা মহিলার শরীরে সাড়ে ৪ লিটার রক্ত থাকে। তবে শরীরের যেকোনো সমস্যা কারণে মানব শরীর থেকে মাত্র দুই লিটার রক্ত বের হয়ে গেলেই জীবন হুমকির মুখে পড়ে। তখন মস্তিস্ক থেকে শুরু করে হৃতপিন্ড, ফুসফুস, কিডনি সব কাজ করতে সমস্যা বোধ করবে। এতে করে আমাদের মস্তিস্ক মাত্র ছয় মিনিটেই মৃত্যুবরণ করতে পারে; ফলে আমরা ব্রেইন ডেড হয়ে যেতে পারি। সাধারণত কোনো দুর্ঘটনা বা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের সার্জারীর সময় মানুষের শরীর থেকে প্রচুর রক্ত বের হয় এবং রক্তের ঘাটতি দেখা দেয়। তখন রোগীর জীবন বাঁচানোর জন্য অতিরিক্ত রক্ত রগের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করাতে হয়। তবে এর ব্যত্যয় ঘটলে রোগীর মৃত্যু সুনিশ্চিত। আর এমনই এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি আমি হয়েছিলাম।
উল্লেখ, বিগত ২০২৪ সলের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকাস্থ ইবনে সিনা হাসপাতালে আমার স্ত্রী শেখ সালমা আক্তারের একটি জটিল অপারেশ হয়েছিল। অপারেশনের ২/৩ দিন পূর্বে বিশিষ্ট গাইনী চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. খালেদা আক্তার বিভিন্ন রির্পোট পর্যবেক্ষণ করে আমার স্ত্রীর রক্তস্বল্পতার কথা বলেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন, অপারেশনের সময় দুই থেকে তিন ব্যাগ রক্ত লাগবে। অতঃপর আমি হন্যে হয়ে আমার স্ত্রীর জন্য ব্লাডডোনার খোঁজতে থাকি।
প্রসঙ্গত, রক্তগ্রুপ বংশগতিসূত্রেপ্রাপ্ত এবং এটি পিতা-মাত উভয়ের অবদানের প্রতিরূপ থেকে সৃষ্টি হয়। মোটামুটি মানব শরীরের রক্তকে আটটি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়। যেমন: A পজিটিভ, A নেগেটিভ, B পজিটিভ, B নেগেটিভ, AB পজিটিভ, AB নেগেটিভ, O পজিটিভ এবং O নেগেটিভ। অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি পদ্ধতি ব্যবহার করে রক্তের গ্রুপ জানা যায়। একজন মানুষের সারাজীবন রক্তের গ্রুপ একই থাকে, কিন্তু সংক্রমণ, ম্যালিগন্যান্সি রোগের কারণে অ্যান্টিজেন যোগ বা হারানোর মাধ্যমে একজন ব্যক্তির রক্তের গ্রুপ পরিবর্তিত হয়। এছাড়া অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের কারণেও রক্তের গ্রুপ পরিবর্তন হয়। আমাদের দেশের বেশিরভাগ নারী-পুরুষের রক্তের গ্রুপ হলো O পজিটিভ! তাই এই গ্রুপের রক্ত সচরাচর পাওয়া যায়। আল্লাহর মেহেরবাণীতে আমার স্ত্রীসহ পরিবারের সকল সদস্যের রক্তের গ্রুপ হলো O পজিটিভ। তখন আমি এটা বেভে আশ্বত্ব হই যে, কোথাও ব্লাডডোনার না পাওয়া গেলে নিজেরাই রোগীকে রক্ত প্রদান করবো।
কিন্তু ভাগ্নে ডা. নিশাত শিকদারের কথা শোনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। সে আমাকে জানায়, নিকটাত্মীয় অর্থাৎ মা-বাবা, সন্তান, ভাই-বোনের রক্ত নিলে একধরনের গুরুতর প্রতিক্রিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘ট্রান্সফিউশন অ্যাসোসিয়েটেড গ্রাফট ভাসার্স হোস্ট ডিজিজ’। যদিও এই রোগ খুব বিরল, কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে ৯০ শতাংশ!
নিকটাত্মীয়ের রক্ত গ্রহণের দুই থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে গ্রহীতার এই রোগ হতে পারে, যার ফলে ফুসকুড়ি, জ্বর বা ডাইরিয়া হতে পারে। এছাড়াও শরীরের ভেতর কিছু পরিবর্তন হতে পারে। যেমন-কিডনি বড় হয়ে যেতে পারে, কমে যেতে পারে রক্তের লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা, অনুচক্রিকা। বয়স্ক কিংবা হৃদপিন্ড, মস্তিস্ক, ফুসফুস ও কিডনিতে অস্ত্রোপচার হয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে।
এতকিছুর পরও যদি নিকটাত্মীয়ের রক্ত নিতে হয়, তাহলে রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে সেই রক্তের প্রতিরক্ষা প্রদানকারী কোষগুলোকে ধ্বংস করে নিতে হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমন ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এধরনের সুযোগ অপ্রতুল। সুতরাং যে কারও রক্তের প্রয়োজন হলে একই ব্লাড গ্রুপের অনাত্মীয় আর নিরাপদ রক্ত খোঁজাই সর্বোত্তম। অবাক হওয়ার বিষয়-আমাদের দেশের বেশিরভাগ চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন!!
ভাগ্নে নিশাত শিকদারের কাছ থেকে এধরনের কথা শোনার পর পরই আমি উদভ্রান্তের মতো দুই ব্যাগ O পজিটিভর রক্তের জন্য সন্ধ্যানী, বাধন, লায়র ক্লাব, রোটারী ক্লাব, কোয়ান্টাম, স্কাউট, রেডক্রিসেন্ট, ব্লাডডোনার বিডিসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়ের ব্লাডডোনেশন সংগঠনগুলোর সাথে যোগাযোগ করতে থাকি। কিন্তু কোথাও থেকে আশানুরূপ সারা পাচ্ছি না!
এমতাবস্থায় অকাল প্রয়াত বন্ধু আব্দুল্লাহ আল বাকির বড় ছেলে স্নেহভাজন আব্দৃল্লাহ আল ওয়াসির সাথে যোগাযোগ করি। সে আবার ব্লাডডোনেশ বিডির সক্রিয় সদস্য ও নিয়মমেনে প্রতি বছর ৩/৪ বার মুমূর্ষ রোগীকে স্বেচ্ছায় বিনামূল্যে রক্তদান করেন। আল্লাহর রহমতে তার রক্তের গ্রুপও O পজিটিভ । কিন্তু সে বর্তমানে পেশাগত কারণে সুদূর ভোলা শহরে অবস্থান করছে! তারপক্ষে অতিদ্রুত ঢাকায় আসা সম্ভব নয়। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে দুই ব্যাগ O পজিটিভ রক্তের আবেদন করে তাদের ফেসবুক গ্রুপে আমার মোবাইল নাম্বার দিয়ে একটি লিখা পোস্ট দেয়।
লেখাটি পোস্ট দেওয়ার এক দিন পর আমার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনের মধ্যমে ১০/১২ জন ব্লাডডোনার সাথে যোগাযোগ হয়। এদের মধ্য থেকে আমি দু’জনকে চূড়ান্ত করি। এদের একজনের নাম রাকিব উদ্দিন, বাসা মো.পুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনূষধে অনার্সে অধ্যয়নরত আর দ্বিতীয়জনের নাম আবিদ আহমেদ, বাসা বসুন্ধরা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনূষধে অনার্সে অধ্যয়নরত। তাদের কথাবার্তায় আমি ভরসাপ্রাপ্ত হই। অতঃপর বিগত ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর আমার স্ত্রীকে ঢাকাস্থ ইবনে সিনা হাসপাতালে গাইনী বিভাগে ভর্তি করাই এবং রাত সাড়ে দশটায় তার অপারেশন শুরু হয়। এইদিকে অপারেশন শুরুর প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে ব্লাডডোনারদের চাহিদা অনুযায়ী যাতায়াত বাবদ তাদের ব্যক্তিগত বিকাশ নাম্বারে ৫০০ টাকা করে মোট ১০০০ টাকা প্রেরণ করি। কিন্তু হায়, টাকা পাওয়ার প্রায় আদা ঘণ্টার মধ্যে তারা তাদের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়!! ডোনারদের এহেন আচরণে বুঝতে পারলাম আমি প্রতারণার শিকার হয়েছি!! তখন আমি দুঃখ-যাতনা ও হতাশায় স্তম্ভিত! আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে-সমাজের সুশিক্ষিত ছেলেরা আমার মতো একজন বয়স্ক ব্যক্তির সাথে বিপদের মুহূর্তে কিভাবে এমন অমানবিক আচরণ করলো !!
এদিকে অপারেশ থিয়েটার থেকে দুই ব্যাগ রক্তের জন্য তাগাদা দিচ্ছে। এই বিপদসঙ্কুল অবস্থায় আত্মীয়স্বজনরা O পজিটিভ রক্তের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। আমরা যখন রক্তের জন্য উদভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছি, তখন হঠাৎ আরমান হোসেন নামে এক যুবক স্বেচ্ছায় O পজিটিভ রক্ত দেওয়ার জন্য দেবদূতের মতো আমাদের সামনে উপস্থিত হয়!! তাকে পেয়ে আমরা আশঙ্কামুক্ত হই। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারি, আমাদের বেয়াই ফারুকুর রহমানের বড় ছেলে জায়েদুর রহমান প্রিতম ব্লাডডোনারকে আমাদের নিকট পাঠিয়েছে। মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষমেহেরবণীতে আরমান হোসেনের বদৌলে আমরা এই বিপদ থেকে উদ্ধার হই।
আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজের সবাইকে বলছি, যখন কোনো অসুস্থ ব্যক্তির জীবননাশের আশঙ্কা দেখা দেয় এবং অন্যের রক্ত দেওয়া ব্যতীত রোগাীকে বাচাঁনোর কোনো পন্থা না থাকে, তখন অনাত্মীয়, চরিত্রবান, সুস্থ, পরিচিত লোকের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে যথার্থ পরীক্ষার মাধ্যমে সুনিশ্চিত হয়ে তা গ্রহণ করোন। আমার মতো কোনো ব্লাডডোনারকে অগ্রীম টাকা দিয়ে প্রতারণার ফাঁদে পরবেন না। যেসব ব্লাডডোনার রক্ত না দিয়ে ছলচাতুরী করে টাকা নিয়ে অসহায় ও মুমূর্ষ রোগীকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, সেইসব মানুষরূপী পশুদেরকে বয়কট করোন। এসব অমানুষদের থেকে সাবধাণ থাকুন। সুতরাং ঝুঁকি এড়াতে নিকটাত্মী ও মাধকসেবীদের কাছ থেকে রক্ত গ্রহণে বিরত থাকুন।
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized