একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। যখন এক এলাকার বিদ্যুৎ চাহিদার তুলনায় উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমান কম হয়, তখন অন্য কোনো এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখে ঐ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখা হয়; এ ব্যবস্থাকে লোডশেডিং বলা হয়।
সাধারণত বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেলে লোডশেডিং করতে হয়। যেমন দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ২২ মেগাওয়াট কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ১৭ মেগাওয়াট, তখন সিস্টেমকে স্টেবল রাখতে বাড়তি ৫ মেগাওয়াট চাহিদাকে উৎপাদনের সাথে সমন্বয় করা হয় লোডশেডিং এর মাধ্যমে। এই সমন্বয়টি না করলে সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি কমে পুরো গ্রীডে ব্লাক আউটের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এই রকম পরিস্থিতিতে বিভিন্ন গ্রীড সাব-স্টেশনগুলিকে তার চাহিদা অনুপাতে একটি বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং এই বরাদ্দ অনুসারে কেন্দ্রগুলি নিদির্ষ্ট পরিমান লোডশেডিং করে। আবার অনেক সময় যথেষ্ট জেনারেশন থাকার পরও অভারলোড জনিত সমস্যার কারণে ফোর্সলি লোডশেডিং করতে হয়। ধারণা করা হয়, এই ফোর্সলি লোডশেডিং বা নরমাল লোডশেডিং এর সুযোগে কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবৈধ বিদ্যুৎ লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে নরমাল লোডশেডিং বা ফোর্স লোডশেডিং একটি নিত্য দিনকার স্বাভাবিক ঘটনা। তবে ইদানিংকালে এই লোডশেডিং অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এ জন্য অবশ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অনেকটা দায়ী।
বৈশ্বিক করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব এখন চরম এক অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত। আর অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে সরকার বিদ্যুৎ সাশ্রয় করার জন্য চলিত ২০২২ সালের জুলাই মাসের ১৯ তারিখে সন্ধ্যা আটটার পর শপিংমল, দোকানপাট বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। অফিস-আদালতের পরিবর্তন হতে পারে। সব দাপ্তরিক কাজ ভার্চুয়ালি করার জন্য বলেছে। নামাজ ও প্রার্থনার সময় ছাড়া মসজিদ ও উপাসনালয়ে এসি বন্ধ রাখতে বলেছে। আর জ্বালানি তেলের চাপ কমাতে সপ্তাহে একদিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বন্ধ রাখা হয়েছে ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র। জ্বালানি গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি( তরল গ্যাস) আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এলাকা ভিত্তিক লোডশেডিং থাকবে। নির্দেশে আরো বলা হয়েছে, পরিস্থিতি দেখে এক সপ্তাহ পর লোডশেডিং দিনে দুই ঘণ্টা করা হতে পারে।
বর্তমানে সব মিলিয়ে পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা আছে ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে, ১৩ হাজার মেগাওয়াট । এই ঘাটতি মোকাবেলা করতেই এখন এলাকা ভিত্তিক প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই ঘণ্টা করে লোডশেডিং করা হচ্ছে। এতে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম লাগবে বলে সরকার বলছে। তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম মনে করেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফাঁকি আছে। যদি রাত আটটা পর্যন্ত শপিংমল ও দোকানপাট খোলা থাকে, তাহলে খুব সামান্য লোডশেডিং হওয়ার কথা, এক থেকে দুই ঘণ্টা নয়। বাস্তবে গ্রামে আগে থেকেই ১/২ ঘণ্টা লোডশেডিং অব্যাহত আছে। এখন সেটা আরো ৪/৫ ঘণ্টা বেড়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় লোডশেডিং এর প্রকৃত হিসাব জনগণকে জানাচ্ছে না। এই অবস্থায় গত ২৮ জুলাই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে সরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বিভিন্ন গণমাধ্যকে বলেছেন, ঘোষণার চেয়ে অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের তথ্য জনগণের কাছে না থাকার কারণে তারা ভোগান্তিতে পড়ছে। যেহেতু আমাদের এখন চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কম, তাই পরিকল্পনা করছি লোডশেডিয়ের সময় বাড়াতে। লোডশেডিং এক ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে দুই ঘণ্টা হতে পারে। এই বিশেষজ্ঞের কথায় বোঝা যাচ্ছে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রনা থেকে জনগণের সহসা মুক্তি মিলছে না।
সরকার বলছে, দেশের শতভাগ এলাকা বিদ্যুৎ নেটওয়ার্কের আওতায় এবং চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপাদনের ক্ষমতা এখন রয়েছে। কিন্তু এই দাবির পাশাপাশি চলিত বছরের ২৩ মার্চ পাঁচটি বেরসকারি ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়িয়েছে। ব্যাপক ব্যয়বহুল এসব ভাড়া বিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আমাদের দেশে অনেক বির্তক আছে। এখন প্রশ্ন আসে-চাহিদার তুলনায় যদি অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা থাকেই, তাহলে ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজন কতটা? সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা আছে ২৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু চাহিদা না থাকায় সরকার অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিতে পারছে না। এজন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এই প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভাড়া ভিত্তিক কেন্দ্র বন্ধ করে দিলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও কমে আসতো এবং মানুষের উপর চাপ কমতো। হিসাব করে দেখা যায়, গত এক দশকে শুধু কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া বাবদ সরকারের খরচ হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। সরকার একদিকে বলছে চাহিদার তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ক্ষমতা আছে, আবার অন্যদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর অনুমোদনও দিয়েছে। এ যেন স্ববিরোধিতারই নামান্তর!!
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্সিটিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস(আইইইএফএ) ২০২০ সালে একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪৩ শতাংশ ব্যবহৃত, বাকি মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫৭ শতাংশ অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া হয়।
২০২১-২২ অর্থবছরে জাতিয় বাজেটে যে ভতুর্কি প্রণোদনা ও বিভিন্ন সংস্থাকে ঋণ দেওয়া জন্য ৪৯ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে তার মধ্যে কৃষির পরের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বিদ্যুৎ খাত। এই বছর এই খাতে ভতুর্কি দেওয়া হবে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, বিদ্যুতের খরচের ক্ষেত্রে উৎপাদনে ৪০ শতাংশ, সঞ্চালনে ৪০ শতাংশ আর সরবরাহে ২০ শতাংশ খরচ হয়। এই প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে সরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলে আসছেন,উৎপাদনের বিষয়গুলো বেশ লোভনীয় ও লাভজনক, তাই সবাই এগুলো বানাতে চায়। রাজনৈতিকভাবে যারা শক্তিশালী, তারাই এগুলোর কন্ট্রাক্ট নেয়। কিন্তু ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশনের ক্ষেত্রে তাদের সেই ধরনের আগ্রহ তেমন দেখা যায় না। (চলবে)
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized