বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত পুরোটাই `লুটপাটের নীত` দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে এমন অভিযোগ অনেকেই করছেন। তবে এর সত্যতা অস্বীকার করার কোনো উপায়া নেই। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের নামে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ করে দেওয়া হয়। তবে তখন এই বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার কোনো ধরনের সুযোগ ছিলো না। সরকারঘনিষ্ঠ একটি বিশেষ গোষ্ঠী এই সুযোগ পেয়েছিলো। মূলত কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিলো সেই সময়কার একটি আপৎকালীন সমাধান। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত অনেকবার প্রতিশ্রুতি, এমনকি প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানিয়েও এই কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উদপাদন কেন্দ্রগুলো বাতিল করতে পারেননি।
বর্তমানে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, “নো পাওয়ার নো মানি” ভিত্তিতে কুইক রেন্টাল বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো চলবে। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। বাস্তবে “স্থির পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ” নামে একটা খাত যুক্ত করা হয়েছে, যার বাবদ সরকারকে গড়ে তিন টাকা দিতে হবে, যেখানে ক্যাপাসিটি চার্জ আগে ছিলো দুই টাকা। তাছাড়া পরিবর্তনশীল মেরামত ও পরিচালনার ব্যয় আগে ছিলো দশমিক ৫ পয়সা; এখন হয়েছে ২৫ পয়সা। ফলে কুইক রেন্টালের পেছনে সরকারের খরচ আগের তুলনায় না কমে বরং বাড়বে। অবাক হওয়ার বিষয় এই চার্জ আবার ডলারে পরিশোধ করতে হবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগের ২০২২ সালের ২৪ জুলাই এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ১৫৩ টি, বিদ্যুতায়িত বিতরন লাইন ৬ লক্ষ ২৯ হাজার কি.মি., বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা ১ কোটি ৮ লক্ষ, সেচ সংযোজন সংখ্যা ২ লক্ষ ৩৪ হাজার, বিদ্যুৎ উদপাদন ২৫,৭০০ মেগাওয়াট, আমদানি বিদ্যুৎ ১,১৬০ মেগাওয়াট, সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩,২৬৮ মেগাওয়াট ৬ জানুয়ারি ২০০৯, ১৪,৭৮২ মেগাওয়াট ১৬ এপ্রিল ২০২২। এই পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যাচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি এখন চরম পর্যায়ে।
বর্তমানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সবচেয়ে বড় পরিহাস হলো, `এই সংকট ও মানুষের দুর্ভোগের জন্য যদি কেউ দায়ী হয়ে থাকে, তবু তার বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। এর কারণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) ( সংশোধন) আইন, ২০২১`। কি অদ্ভুত আইন! বিভিন্ন কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। বিদ্যুতের কাঠামোগত দক্ষতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৪ তম বিশ্বের ১২৭ টি দেশের মধ্যে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম একটি সমস্যা হলো সিস্টেম লস। মূলত সিস্টেম লস দুই কারণে হতে পারে। একটি হলো ডিস্ট্রিবিউশনের কারণে লস, আরেকটি ট্রান্সমিশনের কারণে লস। প্রতি বছরই বিদ্যুৎ খাতে সিস্টেম লস হচ্ছে ৪২ শতাংশ। অপর দিকে বিদ্যুত উৎপাদনের অন্যতম উপাদানের অন্যতম উৎস গ্যাস খাতে প্রতি বছর সিস্টেম লস হচ্ছে মোট উদপাদনের ২ শতাংশ। প্রতি দিনই নিজস্ব উৎস ও আমদানি গ্যাস থেকে চুরি হচ্ছে ৯ শতাংশ। এটা আমাদের আমদানি করা এলএনজির প্রায় অর্ধেক। সুতরাং অবিরাম ও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতের এই সিস্টেম লস দ্রুত কমিয়ে আনা দরকার।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম.তামিমের মতে, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উৎস প্রকৃতিক গ্যাস ও ডিজেল। তবে এর মধ্যে বিদ্যুতের ৫১ শতাংশ আসে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে অবগত হওয়া যায়, দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের সরবরাহ ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছিলো ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু বর্তমানে তা কমে এসে ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটে ঠেকেছে। তবে এই সময় দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস কমার সঙ্গে সঙ্গে নতুন গ্যাস ক্ষেত্রের অনুসন্ধান না করে বিশেষ মহলের পরামর্শে সরকার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি(তরল গ্যাস) আমদানি শুরু করে। অথচ এ দেশের স্থলভাগ ও সাগরতলে এখনো ৩২ থেকে ৪২ টি টিসিএফ গ্যাসের ভান্ডার বিদ্যমান! এই প্রসঙ্গে খ্যাতিমান ভূতত্ববিদ ড. বদরুল ইমাম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেছেন, কয়েকজন প্রভাবশালী এলএনজি আমদানিকারকের অন্যায্য কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্যই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা গ্যাস অনুন্ধানকে “কোল্ড স্টোরেজে” পাঠিয়ে দিয়ে দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনকে এলএনজি আমদানি নির্ভর করে রেখেছেন। সরকারের এ ধরনের নেতিবাচক পরিকল্পনা সত্যিই দুঃখজনক ও জাতিয় স্বার্থের পরিপন্থি! (চলবে)
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized