আজ প্রায় ১৮ দিন হতে চলছে দেশব্যাপী লোডশেডিং অব্যাহত আছে। জ্বালানি সঙ্কটের কারণে সৃষ্ট এই লোডশেডিং জনদুর্ভোগ ঘটাচ্ছে ও জনজীবন ব্যয়বহুল করে তুলছে। দেশের অনেক জায়গায় লোডশেডিং এর প্রতিবাদে মিছিলও হচ্ছে। বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইজাজ হোসেনের মতে, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ও জ্বালানির সংস্থানের মধ্যে সমন্বয় করতে না পারার কারণে আমরা বর্তমানে এক বিশৃঙ্খল অবস্থায় দাঁড়িয়েছি। ২০০৬-০৭ সালের দিকে আমাদের সমস্যা ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা। এখন সেই সমস্যা নেই। বর্তমানে যেই সমস্যাটা আমাদের প্রকট, সেটা হচ্ছে চলমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানোর জন্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। সরকার এই জায়গায় প্রবল ব্যর্থ হয়েছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থতার কারণে লোডশেডিং, গ্যাস সরবরাহে সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। তার মতে, বিদ্যুৎ, গ্যাস, কয়লা ও তেলের মধ্যে যদি আমরা সুন্দর সমন্বয় করতে পারতাম, তাহলে আজকের এই অবস্থায় আমাদের পড়তে হতো না।
অভিজ্ঞমহলের মতে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বিগত দিনগুলোতে যখন কম ছিল, তখন আমাদের দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল প্রচুর তেল মজুত করে রাখা। কিন্তু জ্বালানি মন্ত্রণালয় কখনোই তেল মজুত কারার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না। যদি ২০২০ সালের দিকে জ্বালানি মন্ত্রণালয় সস্তায় ক্রয় করে কমপক্ষে দুই বছরের জন্য তেল মজুত করে রাখতে পারতো, তাহলে এখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ডিজেল আমদানিতে যে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, তা লাগতো না। সরকারের দূরদর্শী চিন্তার অভাবের কারণে আজকে দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গভীর সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
বাস্তবে সরকারের নির্দেশিত কৃচ্ছ্রসাধনের পরিকল্পনা পুরোপুরি সার্থক হলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালায়ের প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার কোটি টাকার মতো সাশ্রয় হবে। কিন্তু এর জন্য আর্থিক মাশুল গুণতে হবে কমপক্ষে দুই থেকে তিনগুণ বেশি। এই লোডশেডিং এর কারণে সামাজিক ও আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কল-কারখান, আমদানি-রপ্তানি সহ বিভিন্ন খাতে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে। এছাড়াও এই লোডশেডিং এর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে সব সময়ের মতো সমাজের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষেরা। এক্ষেত্রে আরো ক্ষতির শিকার হবেন তরুণ জনগোষ্ঠী, যারা স্বউদ্যোগে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এই তরুণদের একটি বড় অংশ ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত। একথা বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমানে ইন্টানেটভিত্তিক কার্যক্রম ও আয়ের উৎস সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই অবস্থায় লোডশেডিং তাদের কর্মসংস্থান ও আয়ের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। সুতরাং এই অবস্থায় বিদ্যুতের ঘাটতি দেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে। এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে যে টাকা বেচে যাবে তার চেয়ে ক্ষতি হবে অনেক অনেক বেশি। সরকারকে এই ক্ষতির পরিমানের কথাও গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।
এই জটিল অবস্থার প্রেক্ষিতে সংগত প্রশ্ন আসে-লোডশেডিং কি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি শঙ্কট প্রতিকারের একমাত্র উপায়? এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের মতে, সরকার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সকল দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলেই বর্তমান সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সুতরাং লোডশেডিং এর কোনো প্রয়োজন নেই। তবে এই প্রসঙ্গে অভিজ্ঞমহলের অভিমত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমাদের প্রধান সমস্যা হলো, প্রাথমিক জ্বালানির স্থায়ী ব্যবস্থা করতে না পারা। এখন যে লোডশেডিং চলছে, তার মূলে রয়েছে প্রাথমিক জ্বালানির সঙ্কট। এই সমস্যা থেকে পরিত্রানের জন্য গ্যাস, কয়লা, তেল, বায়োমাস, জলশক্তি, সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তির মধ্যে সুন্দর সমন্বয় করতে হবে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। তবে দেশে অরিশোধিত তেল পরিশোধন করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের সব কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হবে এবং তাদের সাথে সম্পাদিত নবায়নচুক্তিও বাতিল করতে হবে। সিস্টেম লস নামে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি চিরতরে বন্ধ করতে হবে। অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। এখনো আমাদের দেশের ৪৮ টি কূপ অবহৃত অবস্থায় রয়েছে। এই সব কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদন সম্ভব, কিন্তু সেগুলো ফেলে রাখা হয়েছে। সুতরাং বিদেশ থেকে বেশি দামে তরল গ্যাস আমদানি না এই সব কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম প্রতিষ্ঠানের সাথে জ্বালানি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইন বৃদ্ধি করতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে সামাজিক উন্নয়নের জন্য লোডশেডিং এর মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। জনগণকেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য জাতিয় ঐক্য খুবই জরুরি। আর সেটা সরকারের একার ব্যাপার নয় এবং একার পক্ষে সম্ভবও নয়।
সুতরাং আমাদের সবাইকে সব সময় মনে রাখতে হবে, বিদ্যুৎ একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের একটি অন্যতম সঞ্চালন ব্যবস্থা-এটাকে আরো শক্তিশালী ও গতিশীল করতে হবে। (আপাতত সমাপ্ত)
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ: দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized