জ্বালানি তেলের উপর ভর করেই গড়ে উঠেছে আধুনিক অর্থনীতি। বিশ্বের শক্তির উৎসের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি দখল করে রেখেছে এটি। তেলের দাম তাৎক্ষনিকভাবেই বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক দাম। বর্তমানে করোনা মহামারিকালে বিশ্বব্যাপী জ্বালানিতেলের বাজারে অস্থিরতা চলছে। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই অস্থিরতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন টালমাটাল অবস্থায় ভোক্তা পর্যায়ে লিটার প্রতি ডিজেল ১১৪ টাকা, কেরোসির ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোলের দাম ১৩০ টাকা নির্ধারন করেছে আদেরদেশের জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। গত ৫ আগস্ট রাত ১০ টায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হেয়েছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের উধ্বর্গতির কারণে পাশ্ববর্তী দেশসহ বিভিন্ন দেশে নিয়মিত তেলের দামের সাথে সঙ্গতি রেখে এর মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম কম হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত ভারতে তেল পাচার হচ্ছে। তাই তেল পাচার হওয়ার আশঙ্কা থেকেও জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো ছিল সময়ের দাবি। এই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ্য করা হয়েছে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়া করপোরেশন(বিপিসি) বিগত ছয় মাসে (২২ ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রয়ে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে আন্তজার্তিক তেলের বাজরে অস্থিরতা বিরাজ করছে এবং এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির কারণে বিপিসি আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে যৌক্তিক মূল্য সমন্বয় অপিরহার্য হয়ে পরেছিল।
জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তির যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে সংগত প্রশ্ন আসে- বিশ্ববাজারে নিম্নসুখী প্রবণতা সত্ত্বেও সরকার কেন এভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াল? এর প্রধান করাণ, সরকার অর্থসংকটে আছে। সরকারের হাতে বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা নেই। তাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর কাছ থেকে ঋণ নিতে হবে। আইএমএফের ঋণ সাধারণত `বাজেটারি সার্পোট` হিসেবেই পাওয়া যায়।
ওই ঋণ নিতে হলে কিছু কঠিন শর্ত মানতে হয়। এর মধ্যে প্রথমই হচ্ছে, ব্যয় কমাতে হবে, ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও আছে কিছু সংস্কার কর্মসূচির বাস্তবায়ন, যা দেশের জন্য মঙ্গলজনক। যেমন,অর্থের অপচয়, টাকা পাচার, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বন্ধ ইত্যাদি। কিন্তু দলীয় লোকদের স্বার্থে আঘাত আসবে বলে, সরকার এগুলো করতে গড়িমসি করে। তা ফেলে রাখে। এখন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বিশ্ব রেকর্ড করে সরকার এই খাতের ভর্তুকি কার্যত তুলে দিয়ে এটাকে অতিলাভজনক খাতে পরিনত করলো।
সরকার কৌশল করে এইভাবে এক ঢিলে দুই পাখি মারল। একদিকে আইএমএফের শর্ত পূরণ করে ঋণ পাওয়া নিশ্চিত করলো। অন্যদিকে জ্বালানি তেল থেকে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আয়ের পথ পরিস্কার করে নিল। উল্লেখ্য, জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণন বাবদ সরকার প্রায় ৩৫ শতাংশ শুল্ক ও কর নেয়। কাজেই এই পণ্যের দাম যত বেশি রাখা যাবে বিপিসিরও তত বেশি লাভ হবে। পাশাপাশি সরকারের শুল্ক ও করের অঙ্কও তত বড় হবে। এখন থেকে জ্বালানি তেলের খাতে আর কোনো ধরনের ভর্তুকি দেওয়ার প্রশ্ন থাকবে না।
এখানে আরেকটি বিষয়ও বিবেচনা করার আছে। আর সেটা হলো পেট্রোল ও অকটেনের দাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বেশ কয়েক দিন আগেও বিভন্ন গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমাদের পেট্রোল ও অকটেন আমদানি করতে হয় না। দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে কনডেনসেট নামক যে উপজাত সামগ্রী পাওয়া যায়, তা দিয়ে দেশেই সরকারের স্থাপিত ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টে পেট্রোল-অকটেন তৈরি করা হয়। তাছাড়া ইস্টার্ন রিফাইনারিতে তেল শোধন প্রক্রিয়া থেকেও কিছুটা পেট্রোল-অকটেন পাওয়া যায়। তাতে দেশের চাহিদা পূরণ হয়। কখনো কখনো কিছু পরিমানে অকটেন আমদানি করতে হয়। সুতরাং এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো-যে পণ্যগুলো দেশেই উৎপাদন, তার দাম বাড়ানো হলো কেন?
বিপিসির লাভ-লোকসান হলো আরেকটি জটিল ধাঁধা। গত ৫ আগস্ট এর জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ্য আছে যে, চলিত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিপিসি ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। কিন্তু তার আগে ছয় বছরে বিপিসি যে ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে, এই টাকা কোথায় গেল?
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে, উক্ত লভ্যাংশ থেকে সরকার নিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা কোথায়? এই প্রসঙ্গে বিপিসি কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলছে, ৩৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই টাকার কোনো ধরনের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না! এখন প্রশ্ন আসে-কোথায় তারা বিনিয়োগ করেছে এই অর্থ?
এখন কেন রাতারাতি ভর্তুকি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হলো? বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তেলের দাম সমন্বয় করা হবে। কিন্তু সত্যিই কি তাই হয়? বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, আমাদের দেশে একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা আবার কমার উদাহরণ খুবই কম। আবার যদি দাম কমেও, তবে যে হারে বাড়ে, সে হারে কমে না।
বস্তুত বিপিসির লোকসান পোষানোর জন্য সরকার যে ভর্তুকি দেয়, সে টাকার উৎস এবং বিপিসির লাভের টাকার উৎস তো অভিন্ন, এই দেশের আমজনতা। তাদের ঘিরেই সরকারের সব আয়-ব্যয়। এখানে ভর্তুকি দেওয়া মানে লস নয়, সেবা। কারণ সরকার কোনো অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান নয় যে, তাকে লাভ করতেই হবে। সরকার হলো সাংবিধানীকভাবে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠন। জনস্বার্থে তাকে ভর্তুকি দিতেই হবে। কারণ এই ভর্তুকির টাকা তো জনগণের কাছ থেকেই বিভিন্ন কর ও রাজস্বের মাধ্যমে আদায় করে নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে সমন্বয়ের নামে তেলের ক্ষেত্রে সরকার যেটা করলো সেটা সেবা নয়, জনগণের সঙ্গে পুরোটাই জবরদস্তি। সরকারের উচিৎ ছিলো বিশ্ববাজারের সাথে সঙ্গতি রেখে আস্তে আস্তে দামের সমন্বয় করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড.সালেহ উদ্দিন আহমেদের মতে, যে হারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, তা অস্বাভাবিক ও অকল্পনীয়। একেবারেই এত দাম বাড়ানো উচিত হয়নি। প্রয়োজন হলে ধীরে ধীরে সময় নিয়ে দাম সমন্বয় করা যেত। এতে একেবারে এত ধাক্কা পড়ত না। কারণ, এখন মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। তার ওপর ডলারের দামও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক চড়া।
ভর্তুকি না কমিয়ে সরকারের তো কৃচ্ছ্রসাধনের আরও অনেক সুযোগ ছিল। অনেক খাতে অপচয় হচ্ছে। অনেক অপ্রয়োজনী প্রকল্প রয়েছে। সেসব খাতে খরচ কমানোর প্রচুর সুযোগ ছিল। কিন্তু সেগুলোতে সে রকম নজর না দিয়ে শুধু তেলের ভর্তুকি তুলে দিয়ে ও দাম বাড়িয়ে গরিবসহ সব শ্রেণির মানুষেরই কষ্ট বাড়ানো হলো। যেকোনো জিনিসেরই সময় নিয়ে সমন্বয় করা উচিত। তেলরে দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে সরকারসহ অনেকেই বলছে, ভারতে তেলের দাম অনেক কম। তাছাড়া, এ দেশে তেলের দাম কম হলে, তা ভারতে পাচার হয়ে যাবে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে কি আমাদের সবকিছুতে তুলনা চলে? শুধু তেলের দাম কম দেখলেই হবে না। অন্য অনেক কিছু তাদের মতো আছে কি না, তা-ও দেখতে হবে। আর পাচারের কথাই যদি বলি, পচার রোধে তো সীমান্তে আমাদের সীমান্তরক্ষি বাহিনী আছে। সুতরাং সার্বিক বিচেনায় জ্বালানি তেলের দাম সরকারের পুনর্বিবেচনা করা উচিত। (চলবে)
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন