আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ােলো; অথচ বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের ক্রমেই কমছে। বেশ কিছুদিন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলে ১১০ থেকে ১১৫ ডলারে মধ্যে ওঠানাম করছিল। ২/৩ মাস আগে দুই ধরনের তেলের দামই বেড়ে প্রতি ব্যারেল প্রায় ১২৫ ডলারে উঠেছিল। কিন্তু এখন তা কমে ৯০ ডলারে নেমে এসেছে। তেলের দাম আরও কমবে বলেই ধারনা করা হচ্ছে। কেননা, ওপেক ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের উৎপাদন বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যখন কমছে, ঠিক তখন জ্বালানি তেলের দাম কেন এতটা বাড়ানো হলো? এখনে কার স্বার্থ জড়িত ছিলো? মূলত সরকার সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা না করে ভেবেছে কেবল দুর্নীতিগ্রস্ত বিপিসির কথা, পরিবহন খাতের প্রভাবশালীমালিকদের কথা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত পূরণ। শোনা যাচ্ছে সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছে।
`জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো মানেই জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া।` করোনায় নাকাল দেশবাসী কাছে এ মূল্যবৃদ্ধি এক বড় আঘাত। মানুষ যখন একটু একটু করে গত দুই বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল, তখন এই মূল্যবৃদ্ধি বজ্রাঘাতেন শামিল। তবে এই মূল্যবৃদ্ধি বা সমন্বয় বিপিসির জন্য আর্শীবাদ স্বরূপ। সরকার এখন জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় না করে, যদি দুই বছর পূর্বে তা করতো তাহলে, জনগণের তেমন সমস্যা হতো না। ওই সময় করোনার মহামারি পরিস্থিতির কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গিয়েছিলো! শুধু বিপিসির লভ্যাংশ কম হবে বলে সরকার তখন তেলের দামের সমন্বয় করেনি। সরকারের এধরনের পক্ষপাতীত্বের আচরণ সত্যিই হতাশা জনক।
বিপিসি বার বার বিভিন্ন গণমাধ্যকে বলছে, চলিত বছরের বিগত ছয় মাসে জ্বালানি তেল আমদানি ও বিক্রি বাবদ তার প্রায় আট হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। কিন্তু বিপিসির এই কথা অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেননা, বিপিসি পরিশোধিত-অরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে একক মনোপলি কোম্পানি। এখানে দেশীয় কোনো কোম্পানির সাথে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তাকে তেল কিনতে হয় না। সে কত দামে তেল কিনে কত দামে বিক্রি করলো, তা শুধু বিপিসি নিজেই জানে, অন্য কেউ তা জানে না বা জানবার কথাও নয়। এক্ষেত্রে আধিপত্য ও কর্তৃত্ব একচেটিয়া বিপিসির। যদি একাধিক জ্বালানি তেল আদানিকারক কোস্পানি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল আমদানি করতো, তা হলে বোঝা যেতো প্রতি অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানি ও বিক্রি করে বিপিসি কত টাকা লাভ করছে ও কত টাকা গচ্ছা দিচ্ছে।
বস্তুত বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাজ হচ্ছে-বিদ্যুৎ উৎপাদন, বন্টন, জ্বালানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলন করা। আর `বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশন`(বিইআরসি) এর কাজ হচ্ছে-গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পেট্রোলিয়াম পণ্য সহ যাবতীয় জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ ও এর মূল্য নির্ধারণ করা। এছাড়া জ্বালানি শিল্পের মধ্যকার বিরোধ নিস্পত্তি করা। কিন্তু বর্তমানে জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় যে প্রক্রিয়ায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। বিশ্বকাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য যদি জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে হয়, তা হলে সেটা করার একমাত্র দায়িত্ব বিইআরসির, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নয়। এখানে সরকার রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন অমান্য করেছে! কনজ্যুমার এসোসিয়েশ অব বাংলাদেশের(ক্যাব) এর জ্বালানি উপদেষ্টা ড.এম শামসুল আলমের মতে, ছয় মাসে আট হাজার কোটি টাকা লোকসানের অজুহাতে সরকার কর্তৃক জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, এটা সম্পূর্ণ বেআইনী। অথচ বিইআরসি আইনের ২২ এবং ৩৪ ধারা মতে, যাবতীয় জ্বালানির দাম বাড়ানোর দায়িত্ব তাদের। ২৭ ,ধারা মতে, বিপিসি বিইআরসির লাইসেন্সি। উচ্চ আদলেতের নির্দেশে বিইআরসি এলপিজির মূল্য নির্ধারণ করছে। বর্তমানে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের দাম বিইআরসি নির্ধারণ করলে বোঝা যেত বিপিসি লিটার প্রতি কত টাকা বেশি দাম নিচ্ছে, কত টাকা মুনাফা করছে এবং কত টাকা লোকসান হচ্ছে। সুতরাং জ্বালানি তেলের অবাধ লুন্ঠন বা সিস্টেম লস দূর করতে হলে এবং খুচরা মূল্য জনগণ বান্ধব করতে হলে, তা বিইআরসির মাধ্যমে করতে হবে। এক্ষেত্রে বিইআরসি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এই প্রসঙ্গে সহমত পোষন করে বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমমা বলছেন, আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছিলাম সরকার ব্যসায়ীদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার জন্য আমাদের কাছ থেকে অনৈতিকভাবে বাড়তি গ্যাসের বিল আদায় করছে। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনছে না। সরকার অনৈতিক ও অমানবিকভাবে এখন আবার গ্যাস ও বিদ্যুতের বাড়ানোর চেষ্টা করছে। সরকার অবৈধ ও অমানবিকভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। এভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো কোনো সঠিক পদ্ধতি না। বিইআরসি থাকতে সরকার কিভাবে আইন অমান্য করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করলো এটা আমাদের প্রশ্ন। এই অবস্থায় তারা আবারো বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে সেটা জনগণের জন্য এক ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি করবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, বিশুদ্ধ বাতাস ও পানির মতো জ্বালানি তেলকেও পাবলিক গুড বা সর্বজনীন পণ্য বলা হয়। এর সংস্থান সরকারকে যে কোনো মূল্যেই করতে হয়। এখানে মুনাফা কখনো মুখ্য বিষয় হতে পারে না। তাই সেটি ভর্তুকি দিয়ে হোক অথবা মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে হোক করা সরকারের অন্যতম নৈতিক দায়িত্ব। এমতাবস্থায় সরকারের উচিত যেভাবেই হোক সাশ্রয়ীমূল্যে সবার জন্য এটি সরবরাহ করা। তাই সরকারের নীতিকে জনসাধারণের কল্যাণমুখী হিসেবে নিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা আপতত স্থগিত করা হোক। (আপাতত সমাপ্ত)
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized