করোনার দীর্ঘায়িত প্রভাবে ক্রমেই নিঃস্ব হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। আয় কমে যাচ্ছে। জীবন রক্ষার তাগিদে জীবিকা হারাচ্ছেন তারা। দারিদ্র সীমার নিচে নেমে দুবেলা খেয়ে-পরে থাকাই কষ্টকর হচ্ছে। এই ভয়াবহ অবস্থায় চলতি মাসের পাঁচ তারিখে রাত দশটার পর হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় অনেক বেড়ে গিয়েছে। নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে দৈনন্দিন ব্যয় আগের তুলনায় ক্রমান্বয়ে দ্বিগুণ হচ্ছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ আজ দিশেহারা এতে অবশ্য অভিজাত শ্রেণির তেমন সমস্যা হচ্ছে না। তারা মহাসুখেই আছেন। রাষ্ট্রের এই সঙ্কটকালে ক্ষমতাসীন এক সিনিয়র মন্ত্রীর অনাহুত কথা সাধারণ জনগনকে দারুন মর্মপীড়া দিয়েছে।
ঘটনাটি হলো- গত ১২ আগস্ট সিলেট এম এ জি ওসমানি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্পে `ভূমি অধিগ্রহণবিষয়ক` মতবিনিময় সভা শেষে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নানা কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো বা এর কারণে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, `সারা বিশ্বে মন্দার ভাব আসছে। এটি একাধিক কারণে। এক কোভিডের কারণে এবং যুদ্ধ। মন্দা এসেছে। বিভিন্ন দেশেও এসেছে। গত বছর বাংলাদেশে জিডিপি ৬ দশমিক ৯৪ হয়েছে। কোথায় মন্দা দেখলেন? বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ ভালো আছে। আমরা তো সুখে আছি, বেহেশতে আছি। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে, একটি পক্ষ এমন প্যানিক ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। এটার কোনো ভিত্তি নেই`।
চলমান সংকটের মধ্যে মন্ত্রীর মুখে `সুখে তো আছি, বেহেশতে আছি` মন্তব্যটি মুহূর্তের মধ্যে নেট দুরিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে অস্থির বাজারে হিমশিম খাওয়া মানুষকে নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের এধরনের অনাহুত বক্তব্যের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংবাদপত্র তীব্র সমালোচনা করছে। এমনকি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও ভীষণভাবে বিব্রতবোধ করছেন।
এই অবস্থায় কিছু ঔৎসুক্য লোকের প্রশ্ন-দেশে এমন কি পরিবেশের সৃষ্টি হলো যে, এই ভয়াবহ অবস্থায় মন্ত্রীসহ দেশের সবাই বেহেশতে অবস্থান করছেন? বস্তুত আমজনতাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে মন্ত্রী এ ধরনের অদ্ভুত কথা বলেছেন। বাস্তবে মন্ত্রীর এই কথার কোনো ভিত্তি নেই। তার এই কথা জনগনকে অবহেলা ও উপেক্ষা করারই নামান্তর।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের মতো একজন উচ্চশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতা এধরনের বক্তব্য কখনো দিতে পারেন না। সংবিধান তাকে সেই অধিকার দেয়নি। জনগণকে মনস্তাত্ত্বিক বা সামাজিকভাবে আঘাত করার অধিকার তার নেই। এমতাবস্থায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের উচিত সত্বর তার এই অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্যের জন্য সাধারণ জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া।
ব্যক্তিগত জীবনে আব্দুল মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের ছোট ভাই। তার বাবা আবু আহমদ হাফিজ ছিলেন সিলেট শহরের আইনজীবী ও দাদা খান বাহাদুর আব্দুল রহিম ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের আসাম সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা। বর্তমানে তিনি সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর আগে তিনি আগস্ট ২০০৯ থেকে আক্টোবর ২০১৫ পর্যন্ত জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিঃসন্দেহে আগাগোড়াই তিনি বনেদি পরিবারের লোক। শ্রেণিগতভাবে তিনি ধনীক বা অভিজাত শ্রেণির লোক। তিনি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। শ্রেণিগত কারণেই তিনি নিরাপত্তার স্বার্থে সব সময় প্রহরী নিয়ে চলাফেরা করেন। সব সময় এসিরুমে বিশাল অট্টালিকায় বসবাস করেন। চলাফেরা করেন ভিআইপি রোডে। তার চলাফেরার সময় প্রচুর যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে মানুষকে বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সাধারণ মানুষের মতো ভাদুড়ঝুলা করে বা গাদাগাদি করে তাকে গণপরিবহনে চলাফেরা করতে হয় না। ভ্রমণের সময় যানজটে পড়তে হয় না। ট্রেন বা বাসের অগ্রিম টিকেটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে যেতে হয় না।
বর্তমানে মন্ত্রী হিসেবে তিনি দামী সরকারি গাড়ি হাঁকাচ্ছেন, সরকারি বিলাসবহুল বাড়ি পেয়েছেন। বাসাবাড়ি ও গাড়ি চালানোর জন্য সরকালি লোকও পেয়েছেন। এ যেন দুনিয়ার জান্নাতি শান্তি!! তার মতো লোকের জন্য তো সাধারণ মানুষ কিভাবে থাকেন সেটা বোঝার প্রয়োজন নেই। এমনকি সেটা তার পক্ষে বোঝা সম্ভবও নয়। তারপরও তিনি সেই সাধারণ অহেলিত মানুষের ভোটেই সংসদ সদস্য নিবার্চিত হয়েছেন। সুতরাং তার নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো সেই অহেলিত সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্য রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা। কিন্তু উল্টো তিনি সাধারণ মানুষকে অবহেলা করে বললেন, `আমরা সুখে তো আছি, বেহেশতে আছি।` তার এই ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন অবজ্ঞমূলক বক্তব্য সত্যিই দুঃখজনক!
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের মতো একজন উচ্চশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতা এধরনের বক্তব্য কখনো দিতে পারেন না। সংবিধান তাকে সেই অধিকার দেয়নি। জনগণকে মনস্তাত্ত্বিক বা সামাজিকভাবে আঘাত করার অধিকার তার নেই। এমতাবস্থায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের উচিত সত্বর তার এই অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্যের জন্য সাধারণ জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ: দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized