বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সংবিাধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদ দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। উক্ত অনুচ্ছেদে উল্লেখ্য আছে, রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি সম্মান বজায় রেখে, অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়সমূহে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধার উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে।
বস্তুত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে-স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ভৌগলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা এবং সমতা বজায় রাখা। বাংলাদেশ শান্তিকামী দেশ হিসেবে সব দেশের সাথেই বন্ধুত্ব কামনা করে এবং একই সাথে কারও প্রভুত্ব স্বীকার করে না। যারা অন্যের স্বাধীনতা খর্ব করে এমন দেশকে বাংলাদেশ সমর্থন করে না। এসব মানবিক ও গণতান্ত্রিক নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়।
বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সুন্দরভাবে তুলে ধরা এবং বিভিন্ন দেশের সাথের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর একাজগুলো সুসম্পন্ন করার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে একজন অভিজ্ঞ, সৎ, নিষ্ঠাবান, সচেতন লোক রাষ্ট্র কর্তৃক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। মূলত একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পৃথিবীর সব দেশেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার ব্যক্তিত্বের উপর দেশের ইমেজ নির্ভর করে। তাকে খুব সাবধানে দেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রেখে বাইরের রাষ্ট্রের লোকদের সাথে কথা বলতে হয়। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে তা হলে তার মন্ত্রীত্ব হারাতে হয়। আবার অনেক সময় শাস্তিরও মুখোমুখি হতে হয়। এতো নিয়ম-নীতির পরও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রে গিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করেছেন।
উল্লেখ্য, গত ১৮ আগস্ট চট্রগ্রামে জন্মাষ্টমীর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ভারতে গিয়ে বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখতে `যা যা করা দরকার` তা-ই করতে অনুরোধ করেছি। আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের ভারত সফরের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য নানা মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষকদের মতে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য কেবল দুই দেশের কূটনীতিকদের জন্য বিব্রতকরই নয়, এটা দেশের জন্য মযার্দা হানিকরও বটে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যে দেশের রাজনীতিতেও ব্যাপক বির্তক তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে কড়া প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকে বলছেন, এটা দেশ ও দেশের মানুষের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে।
পরের দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী গোপালগঞ্জে টুঙ্গিপাড়ায় এই বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন। তিনি নিজের আগের দিনের বক্তব্যের ব্যাখা দিতে গিয়ে বলেন,`আমি বলেছি, আমরা চাই শেখ হাসিনার স্থিতিশীলতা থাকুক। এই ব্যাপারে আপনারা (ভারত) সাহায্য করলে আমরা খুব খুশি হব`। একই দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই লজ্জাজনক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বলেছেন, ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতরকে অনুরোধ করতে সরকার কাউকে দায়িত্ব দেয়নি। আওয়ামী লীগ এ ধরনের অনুরোধ করেনি। ভারত আমাদের দুঃসময়ের বন্ধু। জনগণ আমাদের ক্ষমতার উৎস। বাইরের কেউ আমাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে পারে না। এটা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবিধান লঙ্ঘন থেকে রেহাই পেতে পারেন না। তার উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার। কারণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাধারণ কোনো মানুষ নন। তিনি রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাই তার এই লজ্জাজনক বক্তব্যকে ব্যক্তিগত মনে করার কোনো সুযোগ নেই। কোনো মন্ত্রীর কোনো বক্তব্য কখনো ব্যক্তিগত হতে পারে না। সেটা সব সময় সরকারের বক্তব্য বলেই বিবেচিত হবে। এটাই নিয়ম। অভিজ্ঞমহলরাও তা-ই মনে করেন। বাংলাদেশ সংবিধানের ৭ (১)-এর অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে,”রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ”। কোনো রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা ব্যক্তি নন। তাহলে আব্দুল মোমেনের মতো উচ্চশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতা কিভাবে এ ধরনের নেতিবাচক বক্তব্য দিলেন! প্রসঙ্গক্রমে সংগত প্রশ্ন আসে-তাবে কি মন্ত্রী মনে করেন রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ নয়, পাশ্ববর্তীদেশ ভারত? এই ধরনের লজ্জাজনক বক্তব্য দিয়ে সত্যিই তিনি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, শপথও ভঙ্গ করেছেন এবং আপামর জনগণকে অবহেলা ও অবজ্ঞা করেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা কারও অজানা নয়। বিশেষ করে ২০১৪ সালের একতরফা নিবার্চনের পাশাপাশি ২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নিবার্চনে আওয়ামী লীগের প্রতি সরাসরি সমর্থন ছিল ভারতের। ২০১৪ সালের নিবার্চনে ভারতের সমর্থন না থাকলে আওয়ামী লীগের জন্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন ছিল, এটাও সবার জানা। কূটনীতিকেরা মনে করেন, ভারতের সমর্থন ও ঘনিষ্ঠতা নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা যদি হয়েই থাকে, তবে সেটা জনসম্মুক্ষে আনাটা ঠিক হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অযাচিত মন্তব্য দুই দেশের কূটনীতিকদের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারকে ক্ষমতায় রাখার চাবিকাঠি জনগণের হাতে। কিন্তু সেই জায়গায় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে বললেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহায়তা চান! এটাতো দায়িত্বশীল ও চিন্তাশীল কথা নয়। মূলত সরকার নিবার্চন করবে দেশের জনগণ। আর সরকার পরিচালনা করবে দেশ। সেখানে ভিন্ন রাষ্ট্রের কিছুই করার নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই
কান্ডজ্ঞানহীন বক্তব্যের তার অযোগ্যতারই প্রমান করেছেন।
দেশের বিজ্ঞ আইনজীবীদের মতে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোনের বক্তব্যকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগই নেই। তার এসব মন্তব্যে পরিশীলতার ঘাটতি রয়েছে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস আপামর জনগণকে খাটু করেছেন, বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীন-সার্বভৌমত্বকে আঘাত করেছেন। এ জন্য তার ও তার দলের শাস্তি অত্যন্ত জরুরি।
বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত দেশ থেকে মধ্যমআয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে, এমন সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর লাগামহীন বক্তব্য থেকে দেশের সক্ষমতার ঘাটতি প্রকাশ পায়। একই সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি নিয়েও সংশয় দেখা দেয়।
সুতরাং সরকারের উচিত এই ধরনের আপত্তিকর ও বিব্রতকর বক্তব্যের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদ থেকে আব্দুল মোমেনকে দ্রুত বরখাস্ত করা।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized