খেলাধুলা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতি চার বছর পর পর আসে ফুটবল বিশ্বকাপ। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দলের লাখ লাখ সমর্থক বাংলাদেশে রয়েছে। তবে উদ্বেগের বিষয়, ফুটবল বিশ্বকাপ আসলেই আমাদের দেশে শুরু হয় বিভিন্ন অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে অনেক সময় মৃত্যুজনিত দুর্ঘটনাও ঘটে!
বর্তমানে বিশ্বকাপের ২২তম আসর বসেছে মধ্য প্রাচ্যের দেশ কাতারে। গত ২০ নভেম্বর শুরু হয়েছে এ মহারণ। অংশ নিয়েছে ৩২ টি দল। গরমের কথা মাথায় রেখে জুন-জুলাইয়ের বদলে এবার বিশকাপ হচ্ছে নভেম্বর-ডিসেম্বরে। প্রিয় তারকাদের পারফরম্যান্স দেখার অপেক্ষায় ফুটবলপ্রেমীদের চোখ এখন টেলিভিশনের পর্দায়। বস্তুত প্রতিটি বিশ্বকাপেই নতুন নতুন তারকা খেলোয়াড়ের আবির্ভাব হয়। পুরনো তারকাদের মধ্যে কেউ কেউ ঝড়ে পড়েন। কার হাতে উঠবে এবারের বিশ্বকাপ তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে চলিত বছরের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বলা হয়ে থাকে ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা। কিন্তু ফুটবলেও মাঝেমধ্যে অঘটন ঘটে যায়। এবারের বিশ্বকাপে দু`বারের চ্যাম্পিয়ান ও অন্যতম ফেবারিট আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে ধরাশায়ী করে প্রথম চমক সৃষ্টি করেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব। চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ান জার্মানিকে ২-১ গোলে হারিয়ে রূপকথার জন্ম দিয়েছে জাপান। আরো চমক সৃষ্টি করেছে আফ্রিকার দেশ মক্কো। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান অধিকারী বেলজিয়ামকে ০-২ গোলে হারিয়েছে।
ফুটবল মহাযজ্ঞের ফেবারিটের তালিকা তৈরি করা হলে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি ও ফ্রান্স ঠাঁই পাবে, কোনো সন্দেহ নেই। স্পেন, নেদারল্যান্ড, পতুর্গাল আর ইংল্যান্ডও অনেকের ফেবারিট। এবারের বিশ্বকাপে মোট ৪৪ কোটি ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। বিশ্বজয়ী দল পাবে ৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। প্রতিটি ডলার ১০৭ টাকা হিসাবে বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমান দাঁড়ায় প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। রানার্স আপ দল পাবে ৩ কোটি ডলার। যার বিনিময় মূল্য বাংলাদেশী মুদ্রায় ৩২১ কোটি টাকা। বিশ্বকাপে যোগ দেওয়া প্রতিটি দেশই কিছু না কিছু পাবে। এই বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতি বাবদ এরই মধ্যে কাতার প্রায় ৩০ হাজার কোটি ডলার খরচ করে ফেলেছে। প্রতিযোগিতা শেষ হওয়া পর্যন্ত খরচ আরও বাড়বে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বিশ্বকাপের ঢেউ আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা মূলত ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা- এ দুইটি শিবিরে বিভক্ত। প্রিয় তারকার ছবি আঁকা জার্সি গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভক্তরা। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার জাতীয় পতাকা উড়ছে অনেকের বাড়ির ছাদে। পতাকার রঙে রাঙানো হয়েছে কারও কারও বাড়ির দেয়াল। অতিউৎসাহী কেউ কেউ জমানো টাকা খরচ করে বা জমিজমা বিক্রি করে কয়েক কিলোমিটার লম্বা পতাকা বানিয়ে খবরের শিরোনমা হয়েছেন। প্রিয় দলের সমর্থনে শোভাযাত্রা বের হচ্ছে এখানে-ওখানে!
প্রসঙ্গত, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল নিয়ে বাংলাদেশের ফুটবল প্রেমীদের এধরনের হাস্যকর উম্মাদনার খবর প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোষ্টে। এটা আমাদের বড় আজর্ন, এ কথা মনে করে পুলকিত হওয়ার কারণ নেই। যা স্বাভাবিক তা সংবাদ নয়। যা অস্বাভাবিক সেটাই সংবাদ হিসেবে গুরুত্ব পায়। সুন্দর একটা উপমা দিয়ে এটা বোঝানো যেতে পারে। যেমন একটা কুকুর যখন একজন মানুষকে কামড়ায় তখন এটা সংবাদ নয়। কিন্তু যখন একজন মানুষ একটা কুকুরকে কামড়ায় তখন এটা সংবাদ হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশের নাগরিক হয়েও সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের প্রতি বাংলাদেশের অগনিত ভক্ত-সমথর্কদের ভালবাসা ও মাত্রাতিরিক্ত উম্মাদনা সঙ্গত কারণেই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি কেড়েছে। পরিতাপের বিষয়, এই উম্মাদনার ছিটেফোঁটাও বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল ঘিরে পরিলক্ষিত হয় না। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এক সময়ের জনপ্রিয় খেলা ফুটবল এখন আর দর্শক টানে না। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থান বলতে গেলে প্রায় তলানিতে। সুতরাং ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে আর মাতামাতি নয়। এখন সময় বাংলাদেশের ফুটবলের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার। সময় বয়ে যাচ্ছে। নিজের চরকায় তেল দেওয়ার উপযুক্ত সময় এটা।
উল্লেখ্য, বিশ্বকাপ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আত্মহারা জাতি বাংলাদেশীরা। এত এত সমর্থক থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক ফুটবল অঙ্গনে আমাদের কোনো অবস্থান নেই! মাত্র তিন লাখ মানুষের দেশ আইসল্যান্ড এখন ইউরোপের উঠতি ফুটবল শক্তি। এবারের বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পার্বে তারা খেলতে পারেনি, কিন্তু ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে গ্রুপ পর্বের শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে খেলেছে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপও।
হতবাক হওয়ার বিষয়, ১৬ কোটি দেশের অধিবাসী হয়েও আমরা কিছুই করতে পারছি না! আমাদের র্যাঙ্কিং ১৯২। আমাদের পাশের দেশ ভারতের র্যাঙ্কিং ১০৬। আর মিয়ারমার এত ঝামেলা নিয়েও আমাদের থেকে এগিয়ে। এমনকি সাফের বাকি সব দেশও এগিয়ে যাচ্ছে, পিছিয়ে শুধু আমরা। এখন প্রসঙ্গক্রমে প্রশ্ন আসে, আর কতকাল বিশ্বকাপে অন্য দেশকে সমর্থন করব? আর কতকাল অন্যের সমর্থনে মিথ্যে খুশিতে মনকে সান্ত্বনা দেবো? আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ কি কোনো দিন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলবে না? বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ ঘানা, সেনেগাল পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না?
লেখক: খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ: দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized