বিদ্যুতের পর এবার এল গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা। একই মাসে দুটোই হয়েছে সরকারের নির্বাহী আদেশে। উল্লেখ্য, বিগত ২০২২ সালের জুনে গ্যাসের দাম গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু সাত মাস পর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে গ্যাসের দাম বাড়ল ৮২ শতাংশ! এবার শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। তবে পরিবহন খাতে ব্যবহৃত সিএনজি, বাসায় ব্যবহৃত গ্যাস, চা-শিল্প ও সার উৎপাদনে দাম বাড়ায়নি সরকার। নতুন দাম চলিত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।
নতুন দাম অনুযায়ী, শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের(ক্যাপটিভ) জন্য ইউনিট প্রতি গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। মাঝারি শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১০ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। হোটেল-রেস্তোরা খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। আর সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা করা হয়েছে। বর্তমানে অস্বাভাবিকভাবে গ্যাসের এধরনের দাম বৃদ্ধির কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে বাজারে পণ্যের দাম আরেক দফা বাড়বে; যা অনিবার্যভাবে মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধির চাপও আদতে পড়বে সাধারণ মানুষের ওপরই। কিন্তু সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে আর কে তোয়াক্কা করে?
সরকারিভাবে স্বীকার করা না হলেও এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে আইএমএফের ভূমিকাই যে প্রধান, তা অতি সহজেই আন্দাজ করা যায়। কারণ সরকার চলমান রিজার্ভ-সংকট মোকাবিলায় আইএমএফের কাছ থেকে আগামী তিন বছরে শর্তসাপেক্ষে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছে। এখন এই ঋণের অর্থ দ্রুত ছাড়ের বিষয়ে জোর দিচ্ছে সরকার। আর আইএমএফের পক্ষ থেকে সবকিছু থেকে ভর্তুকি কমানোর পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে। এসব শর্ত পূরণ হলে চলিত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম কিস্তি বাবদ ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার পাওয়া যাবে। এর পর প্রতি ছয় মাস পরপর একটি করে কিস্তি পাওয়া যাবে। সাত কিস্তিতে দেওয়া এ ঋণের শেষ কিস্তি পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। এই পরিস্থিতিতে সরকার একের পর এক তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে।
সরকার তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতেই পারে। তবে তা যৌক্তিক পর্যায়ে হওয়া উচিত। কিন্তু এক লাফে কয়েক গুণ দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক ও অমানবিক। এটা একটি দেশপ্রেমকি সরকারের জনবান্ধব কর্মপন্থা হতে পারে না। উল্লেখ্য, ২০০৯ সাল থেকে দেশে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতো গণশুনানির মাধ্যমে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন(বিইআরসি) এটা করতো। এতে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার কারণে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানো যেতো না। গত ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিইআরসি`র উক্ত আইন সংশোধন করে এই ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় সরকার। এরপর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা এলো সরকারের নির্বাহী আদেশে। এর মাধ্যমে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সর্বজনগ্রাহ্য গণশুনানির আইনি প্রক্রিয়াটিকে উপেক্ষা করা হলো।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে আমাদের দেশে দৈনিক গ্যাসের মোট চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু দৈনিক সরবরাহের সক্ষমতা আছে ৩৭৬ কোটি ঘনফুট। আর এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২৬৬ কোটি ঘনফুট। তবে দৈনিক ৩১০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ মোটামুটি নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু সরকার সেই পথে হাঁটছে না। সরকারের সেই ধরনের কোনো উদ্যোগও নেই। সরকার আছে কেবল দাম বাড়ানোর তালে। তবে দাম বাড়ালেও সরকার এলএনজি আমদানি করে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ আছে।
জ্বালানি ক্ষেত্রে কোনো টেকসই সমাধানের দিকে না গিয়ে সরকার দাম বাড়িয়ে চলমান সমস্যার সমাধান কেন খুঁজছে, তা সুস্পষ্ট নয়। আমাদের দেশে জ্বালানি খাতে সরকারের পরিকল্পনাহীনতার ছাপ স্পষ্ট। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সঙ্গে সমন্বিত পরিকল্পনায় সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের সক্ষমতা তৈরি না করায় উৎপাদিত বিদ্যুতের সঠিক সুফল আসছে না; বরং দলীয় ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা চুক্তির ফাঁদে “ক্যাপাসিটি চার্জের” নামে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে প্রতি বছর হাজার হাজার টাকা নিয়ে গেছে এবং এখনো যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, কুইক রেন্টাল ও প্রাইভেট পাওয়ার প্ল্যান্টের মালিকরা বিগত ১১ বছর যাবৎ ঘরে বসে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল তৈরির পেছনে যে টাকা খরচ হেয়েছে, এই টাকা প্রায় তার সমান!
বিদ্যুৎ খাতের মতোই সরকারের ভুল পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতা পেয়ে বসেছে গ্যাস খাতকেও। অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর না দিয়ে চড়া দামে আমদানি করা হচ্ছে এলএনজি। ফলে বারবার বাড়ছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। আর এর চাপ সহ্য করতে হচ্ছে গ্রাহককে। এই প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, যদি দেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান করা হতো, তা হলে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য খরচ পড়ত দেড় টাকারও কম আর বর্তমানে আমদানি করা এলএনজি গ্যাসের দাম পড়ছে প্রতি ইউনিট ৩০ থেকে ৫০ টাকা। যেটির দাম কম, সরকারের তো সেটাই করা উচিত। কিন্তু সরকার হাঁটছে উল্টো পথে। গত চার বছরে সরকার এলএনজি আমদানি করতে ব্যয় করেছে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ একই সময়ে দেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জাতীয় সংস্থা বাপেক্স পেয়েছে মাত্র এক হাজার কোটি টাকা। অবাক হওয়ার বিষয়, সরকার গ্যাস আমদানির জন্য ৮৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলো, কিন্তু বাপেক্সকে শক্তিশালী করার জন্য, গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য তাদের কাছে কোনো টাকা নেই! তবে বাপেক্সকে আরো কিছু টাকা বাড়িয়ে দিলে তাদের নিজেদের অনুসন্ধানের ফলে নতুন গ্যাস ক্ষেত্র পাওয়া যেতো।
বস্তুত প্রাপ্ত গ্যাসের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার ও নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান কাজে সরকারের কোনো উৎসাহ ও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। কারণ এতে আমদানিকারকদের বিরাট অঙ্কের মুনাফা জড়িত রয়েছে। গ্যাস অনুসন্ধান বাদ দিয়ে আমদানি নির্ভর হয়ে সেই বাড়তি টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে। এতে গ্রাহকদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। চুরি-অপচয়, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সিস্টেমলস ইত্যাদি না কমিয়ে দফায় দফায় তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের পকেট কাটার সরকারি নীতি মোটেই গ্রহনযোগ্য নয়। আমজনতার স্বার্থে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সরকারকে প্রয়োজনে অবশ্যই ভর্তুকি চালিয়ে যেতে হবে।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized