সারাহ ইসলাম নামে এক বিশ বয়সের তরুণী ২০২৩ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে ঢাকাস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যবরণ করেন। নিজে মারা গিয়ে তিনি চারজনকে দিয়েছেন এক নতুন জীবন। মরণোত্তর অঙ্গ দানের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন না হলেও সারাহ ইসলামের এই অঙ্গ দানের ঘটনাটি নানা কারণে বেশ ব্যতিক্রমী এবং আমাদের চিকিৎসা দুনিয়ায় এক নতুন ইতিহাসের জন্মদিতে সক্ষম হয়েছে।
অঙ্গদাতা সারাহ ইসলাম ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। তার বাবার নাম শহিদুল ইসলাম ও মার নাম শবনম সুলতানা। জন্মের পর দশ মাস বয়সে সারাহ দুরারোগ্য মস্তিস্কের টিউবারাস সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হন। এই রোগ ভালো হওয়ার কোনো উপায় এখনো পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি। এই যন্ত্রণাদায়ক রোগের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হতো তাঁকে। এই অবস্থায় সারাহ অগ্রনী হাই স্কুল থেকে এসএসসি এবং হলিক্রস কলেজ থেকে এইএসসি পাস করে। তারপর ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলমেন্ট অল্টারনেটিভের চারুকলা বিভাগে ভর্তি হন। সারাহ উক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে সারাহ মেধাবী, দানশীল ও পরোপকারী ছিলেন।
চলিত বছরের ১০ জানুয়ারি সারাহ ইসলাম তাঁর মস্তিস্কের টিউমার অপারেশনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ওই দিনই জরুরি ভিত্তিতে তাঁর মস্তিস্কের টিউমার অপসারনের জন্য একটি অপারেশন করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যখন সারাহ বুঝতে পারেন তাঁর অবস্থা ভালো না, সেই মুহূর্তে মাকে বলে যান, মৃত্যুর পর যেন তাঁর সব অঙ্গ মানব কল্যাণে দান করা হয়।
টিউমার অপারেশনের পর অবস্থার অবনতি হলে পরে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয় এবং `ব্রেন ডেথ` ঘোষণা করা হয়। তখন চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন সারাহকে আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। এমতাবস্থায় তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মার সম্মতিতে ১৮ জানুয়ারি পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়।
সারাহ তাঁর পুরো অঙ্গটাই মানব কল্যাণে দান করে গেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে হার্ট, লিভার সহ অন্যান্য মানব অঙ্গ ট্রানপ্ল্যান্ট এখনো সেভাবে শুরু হয়নি বলে কিডনি ও কর্নিয়া ছাড়া অন্য অঙ্গগুলো নেওয়া হয়নি। তবে সেগুলোর ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
সারাহ ইসলামের মনণোত্তর অঙ্গ দান করে যাওয়ায় তাঁর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে দুজনের দেহে আর কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে দুজনের চোখে। আমাদের দেশে মরণোত্তর কর্ণিয়া দানের ঘটনা আরও থাকলেও মরণোত্তর কিডনি দান ও প্রতিস্থাপন এটাই প্রথম। কিডনি দুটি পেয়েছেন দুই নারী এবং কর্ণিয়া পেয়েছেন একজন নারী ও একজন পুরুষ। তাঁরা চারজনই সুস্থ আছেন।
আমাদের দেশের সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই মহৎ কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। মৃত ব্যক্তির অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিষয়টি আত্ময়ীস্বজন ও পরিবারের সদস্যরা খুব সহজে মেনে নিতে চায় না। সারার পরিবার বিষয়টি উদার ও মানবিকভাবে গ্রহন করেছে। আর জন্যই আমাদের চিকিৎসা জগতে এমন ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনাটি ঘটল।
সারাহকে বীরের মযর্দা দেওয়া উচিত। মরণোত্তর কিডনি দানে উদ্বুদ্ধ করতে সারাহ এই দান মানুষের কাছে উদাহরন হয়ে থাকবে। মরণোত্তর অঙ্গদানের বিষয়ে ইসলাম ধর্মের নির্দেশনা নিয়ে অনেকেই ভুল ব্যাখ্যা দেন। ইসলাম ধর্মে বলা আছে, মরণোত্তর সবাই অঙ্গ দান করতে পারবে কিন্তু বিক্রি করতে পারবে না। এটা আল্লাহ পাকের দেওয়া জিনিস। পবিত্র কোরআনের সুরা মায়েদার ৩২ নাম্বার আয়াতে উল্লেখ আছে, “একটা মানুষের জীবন বাঁচানো মানে সারা পৃথিবীর মানুষের জীবন বাঁচানোর সমান”। এই আয়াতটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করলেই বুঝা যাবে যে, অঙ্গ দানে ইসলাম ধর্মে কোনো নিষেধ নেই। তবে অঙ্গদান হতে হবে মানব কল্যাণে ও নিঃস্বর্থভাবে; এখনে আর্থিক লেন-দেন বা লাভ-লোকসানের কোনো সম্পর্ক আনা যাবে না। সুতরাং কারো যদি কোনো সুযোগ থাকে, তাহলে মরণোত্তর অঙ্গ দান করা উচিত। কারণ এই অঙ্গ দানের মাধ্যমে একজন মরনাপন্ন ব্যক্তি সুন্দর এই পৃথিবীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারবে। এর চেয়ে বড় সদকা ও মহৎ কাজ পৃথিবীতে আর কিছুই হতে পারে না।
উল্লেখ্য, কোনো ব্যক্তি `ব্রেন ডেথ` ঘোষিত হওয়ার পর তাঁর কিডনি, হৃদপিন্ড, ফুসফুস, লিভার, প্যানক্রিয়াস, খাদ্যনালির মতো অঙ্গগুলো দান করলে অন্য ব্যক্তির দেহে তা প্রতিস্থাপন করা যায়। সহজভাবে বলা যেতে পারে, রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে এই অঙ্গগুলি অন্যের দেহে প্রতিস্থাপন করা যায় না। তবে হৃদপিন্ড থেমে গেলেও কর্ণিয়া, অস্থি, অস্থিমজ্জা ও চর্ম প্রতিস্থাপন করা যায়। চিকিৎসা শাস্ত্রে এগুলোকে `ক্যাডভেরিক প্রতিস্থাপন বলা হয়।
সাধারণত মৃত্যপথযাত্রীরা বিগত দিনগুলোর জন্য আপসোস করেন। তখন শুধু অনুশোচনা জাগে-কি করেছিলাম, কি করা উচিত ছিল; এসব হিসাব নিকেশে গিয়ে সে অস্থির হয়ে ওঠে। সেই অবস্থায় সারার মতো একজন বিশ বছর বয়সী মুমূর্ষ তরুণীর দৃঢ়তার সঙ্গে মানব কল্যাণে নিজের দেহ দান সত্যিই বিস্ময়কর বিষয়! সারার দেহ দান মানব কল্যাণে পৃথিবীর সেরা উপহার। সারাহ ইসলামের এই মরণোত্তর দেহ দান সত্যিই তুলনহীন।
মুত্যু পৃথিবীর চিরন্তন সত্য। আর এই নিয়ম অনুযায়ী সারা ইসলাম পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। কিন্তু সারা চলে গেলেও তাঁর দেওয়া কিডনি নিয়ে নতুনভাবে বাঁচার সুযোগ পেয়েছেন দুজন মানুষ। আর তাঁর দান করা কর্ণিয়া প্রতিস্থাপনের পর আরও দুজন পৃথিবীটাকে দেখতে পাচ্ছে নতুন করে। আশা কার যাচ্ছে, তাঁর এই ত্যাগের মাধ্যমে আমাদের দেশের মানুষের মাঝে মরণোত্তর অঙ্গ বা দেহ দানের বিষয়ে আরও অধিক সচেনতা ও ধারণা তৈরি হবে। আমার বিশ্বাস, সুন্দর এই পৃথিবীর মানুষের জন্য সারার মতো সবাই মরণোত্তর অঙ্গ দানে এগিয়ে এসে মরনাপন্ন ব্যাক্তিকে নতুনভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করবেন এবং মরে গিয়েও তাদেরই মাঝে বেঁচে থাকবেন।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized