মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে বাগযন্ত্রের সাহায্যে যে অর্থবোধক ধ্বনিসমষ্টি উচ্চারণ করে সে ধ্বনিসমষ্টির নামই ভাষা। ভাষা মানবসভ্যতার পূর্বশর্ত। ভাষা হল মানবসভ্যতার ধারক ও বাহক এবং ভাষা ও সভ্যতার বয়স এক। গবেষকদের ধারণা, প্রাচীন মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করত বিভিন্ন উপায়ে যেমন-ইশারা, অর্থহীন অস্ফুট ধ্বনি, নানা রকমের রেখা, নকশা ও চিত্র অঙ্কনের দ্বারা। তারপর এসেছে মুখের ভাষা।
মানুষ কিভাবে ভাষা ব্যবহার করতে শিখেছে এবং কিভাবে ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নিয়ে বিস্তর গবেষেণা হচ্ছে। ভাষার উৎপত্তির সঠিক তথ্য এখনও পর্যন্ত নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে এ অবস্থায় ভাষার বিষয়ে একটি উৎস অত্যন্ত জোরালো বক্তব্য পেশ করে এবং সেই বক্তব্যে ভাষার ইতিহাস এবং তার ধারাবাহিকতা ও যোগসূত্রের প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে; তবে এ বিষয়টি সম্পূর্ণ বিশ্বাস নির্ভর। উৎসটি হচ্ছে পবিত্র মহাগ্রন্থ কোরআন। ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে এই মহাগ্রন্থের সূরা আর রাহমান ও সূরা হুজরাতে বলা হয়েছে-“আল্লাহ মানুষ সুষ্টি করেছেন এবং তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন, অতঃপর তাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছেন, যাতে তারা পরস্পরকে চিনতে পারে”।
এই শাশ্বত তথ্যের ভিত্তিতে করে বলা যেতে পারে মানুষ যখন পৃথিবীতে এসেছে তখন কথা বলার যোগ্যতা নিয়েই পৃথিবীতে পদর্পন করেছে। পৃথিবীতে যে দু’জন মানুষ প্রথম এসেছেন তাদের ধ্বনি তারতম্যে বিভিন্ন ভাষার জন্ম হয়েছে বলা যেতে পারে। এমন মন্তব্য গ্রহণযোগ্য কিনা তা ভাববার অবকাশ রয়েছে, পবিত্র কোরআনের তথ্য থেকে অনুমান করা যেতে পারে পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলো একটি ভাষা থেকেই সময়ের ব্যবধানে উচ্চারন তারতম্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করে থাকতে পারে। পৃথিবীর আদি নর-নারী আদম ও হাওয়া এবং তাদের ভাষা ছিল আরবী। তবে এটাও অনেকটা অনুমান নির্ভর। তরাপরও এ তথ্যকে সামনে রেখে ভাষার উৎপত্তি বিষয়ে নতুন করে গবেষণা হওয়া জরুরী।
জনমত গঠনে, বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা – অভিজ্ঞান অর্জনে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিবিধ প্রয়োগ ও আবিষ্কারে, ধর্মীয় মতবাদ ও অন্যসব আদর্শ প্রচারে ভাষা অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম। জীবনের সব স্তরে, সমাজ ও জগতের সবক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহার ও উপযোগিতা অবশ্যম্ভাবী। সার কথা, ভাষা মানুষের সহজাত মাধ্যম। পরস্পরের ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে ভাষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশ, কাল ও পরিবেশভেদে ভাষার পার্থক্য ও পরিবর্তন ঘটে থাকে। ভাষা সমষ্টিগত স্মৃতির সৃষ্টিশীল সংরক্ষক। ভাষা ছাড়া তো মানুষ মূক ও বধির। ভাষা কোনো একটি শ্রেণির নিজস্ব সম্পত্তি নয়। ভাষার সৃষ্টি সমবেতভাবে, সমষ্টিগত উদ্যোগে। বিশেষ শ্রেণি, তা সে যতই ক্ষমতাবান হোক, ভাষাকে যে আটকে রাখবে , সেটা সম্ভব নয়। অতীতে সম্ভব হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না।
বস্তুত ভাষার দুটি রূপ। একটি কথ্য,অন্যটি লেখ্য। কথ্য ভাষার প্রভাব ও কার্যকারিতা সীমাবদ্ধ। কিন্তু ভাষার লেখ্যরূপ অনেক বেশি শক্তিশালী, কার্যকর ও স্থায়ী- যেমন বিচিত্র তার ব্যবহার, তেমনি অবাধ, তুলনাহীন তার প্রভাব, স্থান-কাল-পাত্রের নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে এর অন্তহীন অভিযাত্রা। ভাষার লেখ্য রূপ অনেক সময় বিশ্বের সবর্ত্র পৌছে যায় কাল থেকে কালান্তরে; তার অনায়াস অধিগম। ভাষা মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ নেয়ামত।
পৃথিবীর আদি থেকে এ পর্যন্ত সব প্রাণীর শব্দ একই ধরনের থেকে গেছে। শুধু মানুষ তার ভাষায় জায়গায় তার শব্দের ভান্ডার এক জায়গায় থেমে থাকেনি। এগিয়েছে মানুষ। যুগে যুগে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রতিনিয়ত মানুষ নিজেরা বদল করছে নিজেদের ভাষা। পৃথিবীর সব ভাষাই রূপান্তর হতে হতে বদল হতে হতে বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে ফের এগিয়ে যাবে ভবিষ্যতের দিকে। ভাষা হলো বহতা নদীর মতো, তাই তো তা থেমে থাকেনি। নিত্য পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মানুষের মুখে মুখে বেঁচে আছে সে আজো। এই কাল পরিক্রমায় বহু ভাষায় মৃত্যু ঘটেছে। সেসব ভাষা মানুষের মুখে আর কখনো ফেরেনা। পৃথিবীর এক সময় শক্তিধর ভাষা ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে হারিয়ে গেছে। বিশ্ব বিজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভাষায় মেসোডোনিয়ায় আজ কজনে কথা বলে?
পৃথিবীর প্রধান তিনটি র্ধমপ্রণেতার অন্যতম যিশুখ্রিস্টের ভাষায়ও প্রায় বিলুপ্ত। দোর্দন্ড প্রতাপশালী বিশ্ব বিজয়ী চেঙ্গিস খানের ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন। ভাষা এগিয়ে যায় তার নিয়মে। পৃথিবির সব কটি ভাষাই বদল হতে থাকে। বদল হয় নতুন শব্দ গ্রহন করে, ঝেড়ে ফেলে পুরানো শব্দ, নতুনের সংযোগ, পুরানো লুপ্তি এভাবেই এগিয়ে যায় ভাষা। ভাষার পৃথিবী এক আর্শ্চয পৃথিবী কারণ ভাষার কোনো র্নিদিষ্ট ভৌগলিক, ধর্মীয়, জাতীয় সীমারেখা নেই। একই ভাষা বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন জাতির মাতৃভাষা হতে পারে। আবার একটি ভাষা কেবল একটি দেশের একটি জাতির, একটি ধর্মের মানুষের ভাষাও হতে পারে। ভাষার আসল সম্পদ শব্দ। যে ভাষা যত অধিক শব্দসম্পদে বিভূষিত, উচ্চারণে ও শ্রবণে যত অধিক বিচিত্র ভাব প্রকাশে সক্ষম, সে ভাষা তত বেশি সমৃদ্ধ ও উন্নত। আর এতেই ভাষার প্রাণশক্তি ও সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে।
আন্তর্জাতিক ভাষা গবেষনা কেন্দ্রের জরিপ অনুযায়ী ২০০৯ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বের প্রায় ৭৬৫৮টি ভাষা এবং প্রায় ৩৯৪০০টি উপভাষা রয়েছে। অনেক ভাষাবিদ ও গবেষকদের মতে, সভ্যতার এই আধুনিক যুগেও প্রতি ১৫ দিন পর একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ভাষাভাষী জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে সারা বিশ্বের ভাষাগুলোকে বেশ কটি ভাষা পরিবারে বিভক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪৬ শতাংশ লোক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত আর ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর বহির্ভুত ভাষাগুলো হলো- ফিনো- উগ্রিক এবং বাস্ক ভাষা, সেমেটিক-হামেটিক ভাষা, আল্টাইক এবং পোলিও-সাইবেরীয় ভাষা , সিনে-টিবেটান ভাষা, সুডানিজ-গিনি ভাষা, আমে রেড ইন্ডিয়ান ভাষা ইত্যাদি।
যিশু খ্রিস্টের জন্মের কয়েক হাজার বছর পূর্বে মধ্যে এশিয়া থেকে উদ্ভুত হয়ে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা একদিকে ইউরোপ ও অন্যদিকে পারস্য ও ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিক অবস্থায় পারস্য ও ভারতবর্ষে আগত ইন্দো – ইউরোপীয় ভাষা দু’টি শাখার মধ্যে এতই সাদৃশ্য ছিল যে, তাদের ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বলা হতো। পরে ঐতিহাসিক কারণে কালের বির্বতনে পারস্য ও ভারতবর্ষে আগত ভাষার স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিকাশ ঘটে। ইরানিয় শাখার আধুনিক বির্বতন ফারসি ভাষা আর ভারতবর্ষে আগত ইন্দো-ভারতীয় ভাষার নাম আর্যভাষা। আর্য ভাষার প্রাচীন রূপ বৈদিক এবং সংস্কৃত ভাষা, মধ্যরূপ পালি ও প্রাকৃত ভাষা আর আধুনিক রূপ পাঞ্জাবী, সিন্ধি, রাজস্থানি, মারাঠি, গুজরাটি, সিংহলি, হিন্দুস্তানি, উড়িয়া, আসামি, বাংলা ভাষা ইত্যাদি। (চলবে)
লেখক : খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized