১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির মহান বিজয়ের মাস ও ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। আজ থেকে ৫২ বছর আগে এই দিনে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে এই স্বাধীনতা আক্রান্ত হয় হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের সহযোগী কিছু নৃশংস ঘাতক বাহিনী দ্বারা। আক্রান্ত স্বাধীনতাকে রক্ষা ও স্থায়িত্বদানের জন্য লাখ লাখ মানুষকে আত্মদান করতে হয়েছে। জাতি- ধর্ম ও মত নির্বিশেষে অসংখ্য মা-বোনকে সম্ভ্রম খোয়াতে হয়েছে, প্রাণ দিতে হয়েছে । আজ থেকে ৫২ বছর আগে আমি ৮-৯ বছরের কিশোর। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনার ধারাবাহিকতা ও সত্যতা পরিবারের সিনিয়র সদস্য, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজানের কাছ থেকে অবহিত হয়ে তা সত্যের কষ্টিপাথরে যাচাই করেছি।
আমার বাবা মোহাম্মদ শমসের খান সাহেব সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগে চাকরি করতেন। তাঁর চাকুরীর সুবাদে তখন আমরা সপরিবারে ময়মনসিংহ শহরের কেওয়াটখালী রেলওয়ে কলোনীতে থাকতাম। আমরা ছিলাম চার ভাই ও তিন বোনের একটি পরিবার। আমাদের বাসা ছিল শম্ভুগঞ্জ রেলওয়ে ব্রিজের পশ্চিম-দক্ষিণ পার্শ্বে। ১৯৭১ সালের নৃশংস ভয়াবহ ঘটনা গুলো আমার স্বচক্ষে দেখা। আজও তা আমার স্পষ্ট মনে আছে।
২৫ শে মার্চ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার এবং নিয়মতান্ত্রিক অসহযোগ আন্দোলনের ২৪ তম দিন। ওই দিন দুপুর দিকে স্থানীয় মরাখোলা মাঠে আওয়ামী লীগের এক বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় বক্তারা পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য রাষ্ট্রপতি আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের নিকট উদাত্ত আহ্বান জানান। অতঃপর মিটিং শেষে উপস্থিত জনতা বিশাল এক প্রতিবাদ মিছিল সম্পন্ন করে যার যার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করেন। বিস্ময়করভাবে ওই দিন গভীর রাতেই ঢাকায় পাক বাহিনীর গণহত্যা শুরু হয় এবং বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। পরদিন ময়মনসিংহ শহরে ঢাকা থেকে কোনো পত্রিকা আসেনি। এসময় স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতারা প্রচার করতে থাকেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে গেছেন এবং উক্ত ঘোষণাটি ইপিআর এর তার বার্তার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়েছে। এই কথা শোনার পর জনগণের মাঝে স্বাধীনতা লাভের স্পৃহা আরো বেড়ে যায়। সবাই যার যার মতো করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। এইদিকে সকাল থেকেই রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র বন্ধ। এতদিন ধরে যে অনবরত পল্লীগীতি ও দেশাত্ববোধক গান শোনা যেতো তাও বন্ধ। এই বৈরী অবস্থা দেখে আমাদের বাসার সবার ভয় বেড়ে গেলো। দারুন উৎকন্ঠ ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে ২৬ মার্চ বিদায় নিল।
এলো ২৭ মার্চ। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। রাস্তা ঘাটে লোক চলাচল খুবই কম। এই দিন অনুমানিক সকাল ৭টার দিকে ঢাকা থেকে আগত লোকদের মাধ্যমে ২৫ মার্চের পাক বাহিনীর নির্মম হত্যাকান্ডের খবর অত্র এলাকায় বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পরে। এমনি ভয়বাহ পরিস্থিতিতে বিকাল দিকে আব্বা আমাদের রেডিওটি অন করেন , অন করার ২/৩ মিনিট পর আমরা এক অবিস্মরণীয় ও উদ্দীপনা মূলক ভাষণ শোনতে পেলাম। এসময় কলোনীর অনেকেই আমাদের বাসায় উপস্থিত ছিলেন। স্পষ্ট ও নির্ভীকভাবে মেজর জিয়াউর রহমান নামে একজন উর্ধ্বতন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে “বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম গনপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দিলেন” এবং জাতির এই সংকটকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহ্বান জানান দেশের আপামর জনগণকে। এই ঘোষণাটি শোনার পর আমাদের মনে বদ্ধমূল ধারনা হলো যে, পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, এই যুদ্ধে আমরা অবশ্যই জয়ী হবো। এর আগ পর্যন্ত বাঙালি এই সাহসী সেনা অফিসারের নাম পূর্ববাংলার মানুষ তেমন কেউ জানতেন না। তারপরও তাঁর এই ঘোষণা প্রশংসার দাবী রাখে। তৎক্ষনাত এই ঘোষণা মন্ত্রের মতো কাজ করে।
মেজর জিয়াউর রহমানের এই উত্তেজনা ও প্রেরণা মুলক বক্তব্য শোনার পর নগরবাসী ও গ্রামগঞ্জের লোকদের মধ্যে নবজাগরনের সৃষ্টি হয়। চারদিকে সাজ সাজ রব চলতে থাকে। এমনি পরিস্থিতিতে ঢাকার নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহ শহরে চাকরিরত বাঙালি ইপিআর বাহিনীর সদস্য এবং স্থানীয়রা যৌথভাবে ওই দিন রাত ১২ টার পর পর ময়মনসিংহ শহরের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী হঠাৎ আক্রমন চালায়। সারা রাত ধরে চলে এই যুদ্ধ। এই আক্রমন চলাকালে ময়মনসিংহ শহরের আশপাশ এলাকা থেকে প্রচুল লোক জামায়াত হতে থাকে এবং তারা দেশীয় হাতিয়ার নিয়ে ক্যাম্পটিকে ঘিরে ফেলে। যুদ্ধ শেষ হয় ভোর ৬ টার দিকে। এই যুদ্ধে ইপিআর ক্যাম্পের ইনচার্জ মেজর কমর আব্বাসসহ প্রায় ১২১ জন বেলুচ রেজিমেন্টের ইপিআর সদস্য নিহত হন আর ১৯ জন আত্মসমর্পণ করেন। তাহের, বাবু, আনোয়ার, দেলোয়ারসহ প্রায় ৭ জন বাঙালি ঘটনাস্থলে নিহত হন আর গুরুতর আহত হন যুবনেতা হারুন আর রশিদ।
খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পের এই আক্রমন ছিল ময়মনসিংহ জেলার প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। স্থানীয় কিশোর-যুবা ও আমজনতা সক্রিয়ভাবে এই প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলে বাঙালি সৈন্যদের পক্ষে একা বিজয়ী হওয়া সম্ভব হতো না। মূলত এই যুদ্ধের পরপরই ময়মনসিংহের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত ইপিআর ক্যাম্পগুলো বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এই যুদ্ধে নিহত পাক-সেনাদের লাশ নিয়ে উৎসাহী নগরবাসী বিজয় মিছিল বের করে এবং ধৃত পাক-সেনাদেরকে জেলখানায় প্রেরন করা হয়। নিহত পাক-সেনাদের লাশ গুলির মধ্যে কিছু দাফন করা হয়, কিছু নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় আর কিছু মাটিতে পোঁতা হয়।
খাগডহরের এই যুদ্ধের পরপরই ময়মনসিংহ শহরে বিশেষ করে রেলওয়ে কলোনীতে অবস্থানরত বিহারীরা শঙ্কিত ও আতঙ্কিত হয়ে পরে। তাঁরা বাঙালিদেরকে অবিশ্বাস করতে থাকে। যদিও বাঙালিদের সাথে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তবে তাদের এই শঙ্কা ও সন্দেহ দূর করার জন্য ময়মনসিংহের রেলওয়ে কলোনীর সিনিয়র ভাইদের উদ্যোগে গঠিত হয় “বাঙালি-বিহারী সম্প্রীতি পরিষদ”। এই পরিষদের সাহসী সদস্য ছিলেন-সাইফুল ভাই, মোবারক ভাই, নূরইসলাম ভাই, রফিক ভাই, বুলবুল ভাই, বাহার ভাই, আলী হোসেন ভাই, নজরুল ভাই, কুতুব ভাই সহ আরো অনেকে। তাঁরা সর্বদা বিহারীদের খোঁজখরব রাখতেন। রাতজেগে তাঁদের পাহারা দিতেন। বাঙালিদের এই ধরনের সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণে বিহারীরা মুগ্ধ হয় এবং তাঁদের শঙ্কা দূর হয়।
বাঙালিদের শত চেষ্টার পরও শহরের আইন – শৃংখলার অবস্থা অবনতি হতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে ময়মনসিংহ শহর জন্যশূন্য হয়ে বিরান ভূমিতে পরিনত হয়। দিন যতই ঘরাচ্ছে অবস্থা ততই ভয়বহতার দিকে যাচ্ছে। একপর্যায়ে ময়মনসিংহ শহর দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণরূপে বিছিন্ন হয়ে পরে। এমনি পরিস্থিতিতে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর স্থানীয় সাংবাদিকদের মাধ্যমে দেশের চলমান অবস্থা সম্পর্কে কলোনীর সবাই অবগত হতো।
এভাবে চলার পর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের বাসার উঠানের পশ্চিম পার্শ্বে শহিদ কাকাকে দিয়ে একটি বিরাট ট্রেঞ্চ খনন করানো হয়। শহিদ কাকা ছিলেন আব্বার ফুফাত ভাই। তিনি চাকরি করতেন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগে আর থাকতেন আমাদের বাসায়। আমাদের এক আত্মীয়র পরামর্শে, আত্মরক্ষার সুবিধার্থে আমাদের মেজভাই মোহাম্মদ নূরুল আফসার খান স্থানীয় কামারের দোকান থেকে সংগ্রহ করেন দেশীয় কিছু অস্ত্র। ১৬ এপ্রিল সকাল দিকে নিজ উদ্যোগ অতিসাহস নিয়ে শাহিদ কাকা একা পায়ে হেঁটে ময়মনসিংহ শহর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেন; দেশের এই সংকটাপন্ন অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক নেতাকে তন্ন তন্ন করেও খোঁজে পাওয়া যায়নি। তবে যাদেরকে পাওয়া গেল তারাও যথার্থ উপায় বলতে পারেননি। অবশেষে আব্বা উনার স্কুল জীবনের বন্ধু ময়মনসিংহে চাকুরীরত পুলিশ বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা মাধ্যমে জানতে পারেন যে, পাক বাহিনী ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ শহর দখল করার জন্য যে, কোনো সময় আক্রমন চালাতে পারে। এমতাবস্থায় সবারই নিরাপদ স্থানে চালে যাওয়া উচিৎ। অতঃপর আমরা কাপড়-চোপড়ব, বাক্স-পেটরা, বেডিং-পত্র ঘুছিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকি। কিন্তু কোথায় যাব তা স্থির করতে পারছিনা। এমনি সময় দেবদূতের মত বিকাল দিকে আমাদের খালাতো ভাই মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী সুদূর নেত্রকোনা শহর থেকে বহু কষ্ট করে আমাদের বাসায় উপস্থিত হন। উনাকে পেয়ে আমরা সবাই প্রাণ ফিরে পাই।
পরের দিন ১৭ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে নেত্রকোনায় জসিম ভাইদের বাসায় যাওয়ার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে গৃহ ত্যাগ করি। বিহারীরা তখন আমাদেরকে আড় চোখে দেখছিলো। আমাদের খালু অর্থাৎ জসিম ভাইয়ের বাবা হেলাল উদ্দিন চৌধুরী তখন পাকিস্তান পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন।আমরা রিকশা যোগে রেলিরমোড় ফেরীঘাট এলাকায় পৌঁছি। তারপর শম্ভুগঞ্জ চড়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য ফেরীতে উঠি।
ফেরীতে তখন আনুমানিক ৫০/৬০ জনের মতো যাত্রী ছিল। যেই মাত্র যাত্রীবাহী ফেরীটি ব্রাহ্মপুত্র নদীর মাঝ বরাবর পৌঁছে তখন হঠাৎ বিকট শব্দ করে দুইটি বোমারু বিমান আকাশে একটি চক্কর দেয়। তখন ফেরীতে অবস্থানরত যাত্রীরা একজন আরেকজনের সাথে বলাবলি করছিল যে, বিমানের পাইলটগন শম্ভুগঞ্জ রেলওয়ে ব্রিজটি দেখার জন্য আকাশে চক্কর দিচ্ছে। আবার কিছু যাত্রী বলছেন, বিমানের পাইলটগন নতুন বিধায় আকাশে চক্কর দিয়ে প্রশিক্ষন নিচ্ছেন। যাত্রীদের মধ্যে এ ধরনের কথোপকথন অবস্থায়ই যাত্রীবাহী ফেরীটি ব্রাহ্মপুত্র নদীর পূর্বপারে শম্ভুগঞ্জ চড়ে এসে পৌঁছে। অতঃপর যাত্রীরা ফেরী থেকে নদীর পারে নামতে শুরু করে। আর এ সময়ে হঠাৎ বিকট শব্দ করে উক্ত দুইটি বোমারু বিমান অসহায় যাত্রীদের উপর অতর্কিত আক্রমন শুরু করে; তখন যাত্রীরা দৌড়া দৌড়ী করে যে যার মত করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। আমি তখন একটি টংঘরের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করি। বিমানের বিকট শব্দ, আগুনের লোলিহান শিখা, মেশিনগানের গুলির শব্দ ও মানুষের আর্তচিৎকারে এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিমান দু’টি চলে যাবার পর দেখী, ১০/১২ টি দোকান দাউ দাউ করে জ্বলছে। ৮/১০ জনের মত লোক ঘটনাস্থলে মারা গেছে ও আমার ছোট বোন রুবীসহ বেশ কয়েকজন লোক আহত হয়ে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। এ ভয়াবহ ঘটনার পরপরই আমরা অতি দ্রুত নদীপার হয়ে পুনরায় বাসায় চলে আসি আর ওইদিকে চিকিৎসার জন্য রুবীকে নিয়ে আব্বা- আম্মা চড়পাড়া হাসপাতালে চলে যান। আমরা বাসায় আসার ঘন্টা খানেক পর সানকীপাড়া, গঙ্গীনিরপাড় ও নিউকালোনীতে বাঙালি – অবাঙালিদের মধ্যে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা শুরু হয়। এই সময় শত চেষ্টা করেও “বাঙালি-বিহারী সম্প্রীতি পরিষদ” ও স্থানীয় প্রশাসন ময়মনসিংহের পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে পারেনি। পরিবেশ-পরিস্থিতি তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ব্যাপারটি ওই সময় একটি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় চারদিকে আতঙ্ক বিরাজ করতে থাকে।
এই বিপদ সঙ্কুল অবস্থায় জসিম ভাইকে বাসায় রেখে আব্দুল করিম নামে স্থানীয় এক লোকের সহায়তায় পায়ে হেটে কেওয়াটখালীর পশ্চিমদিকে রওয়ানা দেই। গ্রামের মেঠুপথ। নির্জন এলাকা। কোথাও কোলাহল নেই। চার পার্শ্বের নিস্তদ্ধতা দেখে আমাদের ভয় আরো বেড়ে যায়। আমারা দ্রুত বলাশপুর ও দিঘীরকান্দা পার হয়ে শিকারীকান্দা গ্রামে কেওয়াটখালী সরকারী রেলওয়ে স্কুলের জনপ্রিয় শিক্ষক আব্দুল মজিদ স্যারের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি। আমাদের মত আরো কয়েকটি বাঙালি পরিবার নিউকলোনী ও সানকিপাড়া থেকে এসে স্যারের বাড়িতে আপাতত আশ্রয় গ্রহণ করে। স্যার আশ্রয় গ্রহণকারী সবাইকে ডাল-ভাত-সবজী ও মুরগীর মাংস দিকে আপ্যায়ন করেন। এখানে আমারা রাত্রি যাপন করি এবং পরের দিন সকালে দিকে আরো পাচঁমাইল দক্ষিন-পূর্বে অবস্থিত ভাংরামারীর চড়ের উদ্দেশ্যে পায়ে হেটে যাত্রা করি। প্রায় আদা ঘণ্টার মধ্যে আমরা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে বয়রা খেয়াঘাটে পৌঁছি। কিন্তু এখানে তো একটি নৌকাও নেই। নৌকার জন্য এখানে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করি। চারপার্শ্বে নিস্তদ্ধতা বিরাজ করছে। এই নির্জন পরিবেশে আমরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরি। এই ভায়াবহ পরিবেশে অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটি নৌকা পাওয়া গেল। এরপর ওই নৌকা যোগে নদী পার হই। অতঃপর আমরা করিম ভাইয়ের এক আত্মীয়র বাড়িতে পৌঁছি।
সূর্য তখন মধ্যগগনে। গৃহকর্তা একজন অবস্থাপন্ন কৃষক। তিনি আমাদেরকে বললেন, যতদিন ইচ্ছা ততদিন আমার এখানে থাকতে পারবেন, কোন সমস্যা নেই। তার এই কথা শুনে আমরা আশ্বস্ত হলাম। ইতিমধ্যে গৃহকর্তী মুড়ি-গুড় দিয়ে আমাদেরকে আপ্যায়ন করলেন। এখানে দুপুরের খাবার সম্পন্ন করে আমারা বেশ কিছু সময় বিশ্রাম নেই। এইদিকে শহরের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। এমতাবস্থায় ওই দিন বিকাল দিকে আমার পায়ে হেটে বাসায় প্রত্যাগমন করি। শহরে এসে দেখী, চারিদিকে আতংকের ছাপ ও সুনসান নিরবতা। সমস্ত কলোনীকে মানে হচ্ছিল কোন এক ভুতুরে পাড়া।
সন্ধ্যা হওয়ার পর পরই এলাকার পরিবেশ ও পরিস্থিতি ভয়ানক আকার ধারন করে। এ সময় স্থানীয় লাঠিয়ালরা বেছেঁ বেঁছে অবাঙালিদের বাসার সমস্ত আসবাবপত্র লুটতরাজ শুরু করে। এ অবস্থায় সুযোগ বুঝে অবাঙালিরা বাসবাবপত্রের মায়া ত্যাগ করে কোনমতে নিজেদের প্রাণ নিয়ে দ্রুত পলায়ন করতে থাকেন। আর যারা ধরা পড়ছে তাদের উপর চলছে অকথ্য নির্যাতন। আনুমানিক রাত আটটার দিকে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য অবলোকন করি। আমাদের বাসার পশ্চিমদিকে লোকোসেডের পেছনের মাঠ থেকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে এবং গগনবিদারী আত্মচিৎকার শোনা যাচ্ছে। এছাড়াও ব্রাহ্মপুত্র নদীর পার থেকে মহিলাদের আত্মসম্ভ্রম বাচাঁনোর বিকট চিৎকার শোনা যাচ্ছে। গভীর রাত পর্যন্ত চলে গণধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যাকান্ড। আমরা তন্দ্রাহিন ও ভীতিকর অবস্থার মধ্যে সারারাত পার করি। শহরের চলমান পরিস্থিতি জানার জন্য কাক ডাকা ভোরে মেজভাই নুরুল আফসার খান ও জসিম ভাই আকুলস্থলে পৌঁছে। অতঃপর কেওয়াটখালী ও এর আশপাশ এলাকায় গিয়ে খোঁজখবর নেয়।
এই দিকে বাসার সবাই তাদের চিন্তায় অস্থির। আমরা ভাবছি, হয়তো বিহারী মুজ্জাফর-ইমতিয়াজ-মুন্না-কালু গ্রুপের লোকেরা তাদেরকে মেরেফেলেছে! কিন্তু আমরা কেউই সাহস পাচ্ছি না ঘর থেকে বের হয়ে তাদের খোঁজখবর নেওয়ার। এমন ভয়ার্ত অবস্থায় তারা বাসায় ফিরে সকাল ৮ টার দিকে। তাদের কাছ থেকে অবগত হলাম, এই পৈশাচিক হত্যাকান্ডে প্রায় শতাধিক বিহারী নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছে। তাদের কাছ থেকে এধরনের ভয়াবহ বর্ণনা শোনার পর আমার সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরি। তবে জসিম ভাই ও আফসার ভাই সাহস হারাননি! অতঃপর বাক্স পেটার নিয়ে সকাল ৯ টার দিকে আমরা পায়ে হেটে নেত্রকোনার উদ্দেশ্যের রওয়ানা দেই। চারদিকে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। রাস্তাঘাট সব ফাঁকা। থমথমে অবস্থা। এমন ভীতিজনক অবস্থার মধ্যে আমরা ফেরিঘাটের দিকে যাচ্ছি।
প্রায় আদা ঘণ্টার মধ্যে আমরা মরাখোলা মাঠ, পাটগুদাম পার হয়ে রেলিরমোড় ফেরিঘাটে পৌঁছি। এখানে বিশালাকার একটি বটগাছের নিচে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করি। সকাল ১০ টার দিকে শম্ভুগঞ্জচড়ে যাওয়ার জন্য আমরা ফেরিতে উঠি। আমারা যথাসময়ে ঠিকমত নদী পার হই। তবে বাসস্ট্যান্ডে মাত্র একটি বাস আছে। চারদিকে আতঙ্কের ছাপ। এমতাবস্থায় নেত্রকোনা যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমরা হন্তদন্ত হয়ে শম্ভুগঞ্জ বাজার থেকে বাসে উঠি। আমাদের বাসাটি যাতাক্রমে শ্যামগঞ্জ, ভবের বাজার, হিরনপুর ও চল্লিশা পার হয়ে অবশেষে নেত্রকোনা সদর বাস ট্যান্ডে এসে পৌছেঁ। এলাকাটির নাম মুক্তারপাড়া। প্রায় দুপুর ২টার দিকে আমরা জসিম ভাইদের বাসায় পৌঁছি। এলাকাটির নাম গৌরীহাটা। হিন্দু প্রধান এলকা। কিন্তু একটি বাড়িতেও কোনো লোকজন নেই, এমনকি কোনো আসবাবপত্রও নেই! সব মালপত্র লুট হয়েগিয়েছে। নিরাপত্তা জনিতকারণে অত্র এলাকার লোকজন ভারতে হিজরত করেছে। বাড়িগুলি এখন স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে।
এখানে প্রায় দেড় মাস অবস্থান করার পর আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে সকাল ১০ টার দিকে নেত্রকোনা স্টেশনে আসি। কিন্তু স্টেশনে আসার পর জানতে পারি, গচিহাটা রেল ব্রিজটি গতকাল মুক্তিযোদ্ধারা ভেঙ্গে ফেলেছে; তাই এই পথে আপাতত ট্রেন চলাচল বন্ধ। এমতাবস্থায় আব্বার পূর্ব পরিচিত এক রেলওয়ে প্রকৌশলীর সহায়তায় ট্রলিতে করে গচিহাটা স্টেশনের আউটার পর্যন্ত আসি। তারপর পায়ে হেটে স্টেশনে পৌঁছি।
কিন্তু স্টেশনের পরিবেশ মোটেই সুবিধাজনক নয়। চারদিকে থমথমে অবস্থা। ৪/৫ টি মানুষের রক্তাক্ত নিথরদেহ প্ল্যাটফর্মে পরে রয়েছে। এমন ভয়াবহ দৃশ্য দেখে আমার অস্থির হয়ে পরি। অতঃপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে একটি লোকাল ট্রেনে ওঠি। তবে ট্রেনটি ছাড়ার পূর্ব মুহুর্তে পাকবাহিনীর সদস্যরা সমস্ত যাত্রীদের মাল-পত্র তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করতে থাকে এবং যাকে সন্দেহ হচ্ছে তাকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে। এ ভীতিকর দৃশ্য দেখে যাত্রীরা সবাই হতবিহ্বল হয়ে পরে। এই ভয়াবহতার যেন শেষ নেই। প্রতিটি যাত্রী তখন মৃত্যুর প্রহন গুনতে থাকে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে পাকসেনারা এখানে-সেখানে ট্রেনটি যাত্রা বিরতী করে। পাশাপাশি তাদের অনুসন্ধান অব্যাহত রাখে।
আনুমানিক দুপুর ৩টার দিকে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ষ্টেশনে এসে পৌঁছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর তখন পাকিস্তান বাহিনীর দখলে। এই বৈরী পরিবেশে কিছু দিন ভাদুঘড় ও কিছু দিন শ্রীপুর গ্রামে বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে অবস্থান করতে থাকি। অবশেষে আমরা আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে বাসুদেব গ্রামে তৎকালীন বাসুদেব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জিয়াউল হক ভুইয়ার বাড়ীতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করি।
আমার স্বচক্ষে দেখা একাত্তরের ভয়াবহতা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। এসব ভীতিকর স্মৃতির কথা মনে পড়লে আজও আমি ভয়ে শিউরে উঠি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়ে ছিল, তা ছিল বিশ শতাব্দীর নৃশংসতম এক গণহত্যা। ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানী বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ডে নাজি বাহিনীর বর্বরতার চেয়েও ভয়াবহ। আমাদের এখন সোচ্চার কন্ঠে দাবি তুলতে হবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী সেনা কর্মকর্তা যাদের আমরা ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য চিহ্নিত করেছি তাদের বিচার করতে হবে। ত্রিদেশীয় চুক্তির মাধ্যমে সিমলায় যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তাতে পাকিস্তান সরকার অঙ্গীকার করেছিল এই সব চিহ্নিত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার করবে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা তা করেনি। সেই ঘৃনিত গণহত্যাকারী সেনা কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবীতে আন্তর্জাতিকভাবে জনমত সৃষ্টি করতে হবে।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : deshdorshon.com
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized