খাঁটি ও নিখাদ দেশপ্রেমিক এবং গরিবের বন্ধু কর্মবীর ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী ওরফে কঁচি চলিত বছরের ১১ এপ্রিল রাত ১১ ঘটিকায় ঢাকার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। মৃত্যুকালে তিনি এক ছেলে-এক মেয়ে, স্ত্রী ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। এই মহান ব্যক্তির মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হয়েছে গোটা জাতি। তাঁর মৃত্যুতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো তা কোনো দিনও পূরণ হবে না।
সারাটা জীবন ডা.জাফরুল্লাহ কাটিয়ে গেলেন গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য। অনুকরণীয়, অনুসরণীয় মানুষটির জীবনের কাহিনী মিথকেও হার মানায়। এই নির্ভিক মানুষটি হাসপাতালে জ্ঞান থাকাবস্থায় নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, তাঁকে যেন উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার কথা চিন্তা করা না হয়। যেই হাসপাতাল নিজে গড়েছেন এদেশের গরিব মানুষের জন্য, সেই হাসপাতালেই যেন তাঁর চিকিৎসা করা হয়। তিনি আরো নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, তাঁর মৃত্যুর পর দেহ যেন দাফন না করে কোনো মেডিকেল কলেজে গবেষনার জন্য দান করা হয়। কিন্তু কোনো মেডিকেল কলেজই তাঁর দেহ গ্রহনে রাজি হয়নি। এমতাবস্থায় পারিবারিক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ১৪ এপ্রিল জুমার নামাজের পর বেলা আড়াইটার দিকে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভেতরে সূচনা ভবনের পাশে নামাজে জানাজা শেষে তাঁকে দাফন করা হয়।
ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্রগ্রামের রাউজান উপজেলার কোয়েপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী সূর্যসেন। পিতামাতার দশজন সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর পিতা হুমায়ুন মুর্শিদ চৌধুরী পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন আর মা হাসিনা বেগম চৌধুরী গৃহিনী ছিলেন, লেখাপড়া তেমন জানতেন না। স্ত্রী শিরিন হক নারী অধিকার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী।
ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী সমাজ সেবার জন্য দেশবিদেশ থেকে বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তাঁর পাওয়া পুরস্কারগুলি হলো-সুইডিস ইয়ুথ পিস প্রাইজ(১৯৭৪), স্বাধীনতা পুরস্কার(১৯৭৭), রামন ম্যাগসাই পুরস্কার(১৯৮৫,ফিলিপাইন), রাইট লাভলিহুড পুরস্কার(১৯৯২, সুইডেন), ইন্টরন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ পুরস্কার(২০০২, যুক্তরাষ্ট্র), সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী(২০২১, কানাডা) ও আহমেদ শরীফ স্মারক পুরস্কার(২০২১)।
ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনাতে একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ সালে ঢাকার নবকুমার হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও ১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৪ সালে উক্ত কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে এফআরসিএস পড়তে গিয়েছিলেন লন্ডনে। তখন তাঁর জীবন ছিল রাজকীয়। বিমান চালানোর লাইসেন্স ছিল; দামি স্যুট, টাই, শার্ট, জুতা পরতেন। দীর্ঘ ৪ বছর কঠোর সাধনার পর ১৯৬৭ সালে রয়েল অফ সার্জনস কলেজ থেকে জেনারেল ও ভাসকুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীরক্ষায় উর্ত্তীণ হন। কিন্তু এইদিকে ১৯৭১ সালে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী শুরু হয় ভায়াবহ মুক্তিযুদ্ধ। আর এর প্রতিবাদে এই সময় আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সারা লন্ডন শহরে প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালিদের মিটিং-মিছিল ও সমাবেশ শুরু হয়। এসব মিটিং-মিছিলে তুলে ধরা হচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের গণহত্যার চিত্র। সেসব সমাবেশ-মিছিলে যোগ দিচ্ছিলেন বিদেশীরাও। তখন মে মাসের দিকে লন্ডনের প্রখ্যাত হাইড পার্কে এরকম একটি সমাবেশ চলছিল। সমাবেশের এক পর্যায়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজের পাকিস্তানি পাসর্পোট ছিড়ে ফেলেন। কিন্তু তখন তাঁর
এফআরসিএস ফাইনাল পরীক্ষার মাত্র সাত দিন বাকি ছিল! অন্য কোনো বাঙালি এধরনের কাজ করত কিনা সন্দেহ আছে। দেশের জন্য তাঁর এই ত্যাগ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। বস্তুত, এই পাসর্পোট ছিড়ে ফেলা ছিল পাকিস্তানিদের গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। ডা.জাফরুল্লাহর এই অবিনব ঘটনা বিদ্যুৎ গতিতে সমগ্র পাকিস্তানে ছড়িয়ে পরে। এমতাবস্থায় অতি দ্রুততার সাথে ডা.জাফরুল্লাহ ও ডা.এম এ মবিন ট্রাভেল পারমিট জোগাড় করে সিরিয়ান এয়ারলাইনসে করে লন্ডন থেকে দিল্লী আসেন। তারপর কলাতায় যান এবং প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক কর্নেল আতাউল গনি ওসমানি, সেক্টর কমান্ডার মেজর হায়দার, মেজর খালেদ মোশারফ ও মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে দেখা করেন এবং তাদের পরামর্শমত গেরিলা যুদ্ধ বুঝতে আগরতলায় চলে আসে। তারপর আগরতলার মেলাঘর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে কিছু দিন গেরিলা প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে বন্ধু ডা.মবিনকে সঙ্গে নিয়ে মে মাসের শেষের দিকে ডা. জাফরুল্লাহ ত্রিপুরার বিশ্রামগঞ্জে শন ও বাঁশের দ্বারা ৪৮০ শয্যার “বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল” স্থাপন করেন। শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালি শরণার্থীদের চিকিৎসা। তৎকালীন সময়ে তাঁর এই ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের কাহিনী বিশ্ববিখ্যাত জানার্ল পেপার “ল্যানসেট”-এ প্রকাশিত হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়রে ডা.জাফরুল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল এক অভাবনীয় সাফল্যের প্রতীক। যদি তিনি তখন ওভাবে হাসপাতাল গড়ে তুলতে না পারতেন বা গড়ে না তুলতেন তাহলে হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা বিনা চিকিৎসায় মারা যেত, অনেকের অঙ্গহানি হতো। এছাড়াও বাঙালি শরণার্থীরা ডাইরিয়াসহ ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করতো। (চলবে)।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized