জীবনের এই চলার পথে আমাদের অনেকের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সেই শৈশব থেকে শুরু করে স্কুল জীবন, কলেজ জীবন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, পেশাগত জীবন ও অবসর জীবন পযর্ন্ত। এক কথায় বলা চলে সব জায়গায়ই থাকে আমাদের বন্ধুত্ব। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন হয়ে ওঠে আত্মার আত্মীয়। একটা সময় ছিল চিঠি-পত্রের মাধ্যমে বন্ধুত্ব করার। এখন চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দেশ-বিদেশ থেকে শুরু করে নিজের পরিচিত গন্ডির বাইরেও চলছে আমাদের বন্ধুত্ব। বেঁচে থাকার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত চলে এই বন্ধুত্ব তৈরির প্রয়াস।
কিন্তু এত এত বন্ধুত্ব কিংবা সম্পর্কের ভিড়েও মাঝে মাঝে আমরা স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে চলে যাই শৈশবের দুরন্তপনার দিনগুলোতে। এমন স্মৃতিতে যেন অবিরাম ছুটে চলতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে আবার ফিরে যেতে ঐ সময়ে। এমন আকুল হয়ে ওঠে শৈশবের বন্ধুদের জন্য। তখন যেন ঐ বন্ধুদেরই জীবনের সব মনে হয়। এমন বন্ধুদের জন্যই জীবনকে সার্থক মনে হয়।
বস্তুত শৈশব-কৈশোরকালের বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যে চাওয়া-পাওয়ার কিছুই থাকে না। প্রত্যাশা বা স্বার্থ থাকে না। এই সম্পর্কে মধ্যে ধনী-গরিবের কোন ব্যবধান থাকে না। সত্যিকার অর্থেই এই সম্পর্ক গুলি খাঁটি ও অকৃত্রিম। শৈশব-কৈশোর কালে এমনি অনেক নিঃস্বার্থ ও অকৃত্রিম বন্ধু আমার ছিল। বয়সের দিক দিয়ে কেউ ছিল সমবয়সী, কেউ ছিল বছর খানেকের জুনিয়র আবার কেউ ছিল ১/২ বছরের সিনিয়র। তাদের মধ্যে ছিলেন-মোহাম্মদ বেলাল, এমদাদুল হক, আবু বক্কর সিদ্দীক বাবু, তৌফিক আলম, জাহাঙ্গীর আলম, মাইনুদ্দীন বাবলু, মনিরুল ইসলাম মনু, সফিকুল ইসলাম ছোট্টু, শহিদুল আমিন খোকন, মফিজুল আমিন মিন্টু সহ আরো অনেকে।
গত ০৩/০২/২০২৩ ইং তারিখ সকাল ১০ টার দিকে আমার মোবাইল ফোনে অপরিচিত নম্বার থেকে একটি কল আসে। একাধিকবার আসার পর কলটি আমি রিসিভ করি। অতঃপর ওপ্রান্ত থেকে বলছে, আমি চাঁদপুরের খোকনের ছোট ভাই মিন্টু বলছি। আজই আমি তোমার সাথে দেখা করার জন্য পাহাড়িকা ট্রেনে চড়ে আখাউড়া আসছি। কথাটি আমার কাছে অবিশ্বস্য মনে হচ্ছিল! তবে তার মুখ থেকে শৈশবকালের বেশ কয়েকটি স্মরণীয় ঘটনা শোনার পর আমি নিশ্চিত হই, এই ব্যক্তিই আমার শৈশবকালের হারিয়ে যাওয়া বন্ধু মফিজুল আমিন মিন্টু, যাকে আমি দীর্ঘ ৪৪ বছর যাবৎ খুঁজছি!! ঐ দিন আমার এক আত্মীয়র বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। এমতাবস্থায় শৈশবকালের বন্ধুর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য উক্ত বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি বাতিল করি। অতঃপর প্রাতরাশ সম্পন্ন করে আখাউড়ার উদ্দেশ্যে সড়ক পথে রওয়ানা দেই।
উল্লেখ্য, মিন্টুর সেজভাই শহিদুল আমিন খোকনও ছিল আমার বাল্যসখা। তাদের বড় ভাই রুহুল আমিন বাংলাদেশ রেলওয়ের সিগন্যাল বিভাগে চাকরি করতেন। এমনকি তাঁর বাবা জবায়েদ উল্লাহ সাহেবও একই বিভাগে চাকরি করতেন। তাদের মেজভাই নুরুল আমিন নুরু কুমিল্লা পলিটেকনিক্যাল কলেজে তখন লেখাপড়া করতেন। তাদের মা নিজের ছেলের মতো আমাকে স্নেহ করতেন। তাদের বাসা ছিল আমার জন্য সব সময় উন্মুক্ত। মিন্টুর বাবা চাকরি থেকে অবসর গ্রহন করেন ১৯৭৮ সালে। এরপর থেকে তারা চাঁদপুরে গ্রামের বাড়িতে বসবাস করছে। কিন্তু ঠিকানা অজানার কারণে এত দিন তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
মিন্টুকে ঘিরে রয়েছে আমরা অসংখ্য স্মৃতি। এখনো মনে আছে, রেলওয়ে স্কুল পুকুরে গোসল করার সময় মিন্টু, আমি, জাহাঙ্গীর, আনিস, আলমগীর, জাকির সহ আরো অনেকে সাঁতার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতাম, বর্ষাকালে তিতাস নদীতে কলাগাছের ভেলায় চড়ে ঘুরে বেড়াতাম, সড়কবাজার থেকে ভাড়ায় সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম কর্ণেলবাজার ও এর আশপাশ এলাকায়, বর্ষাকালের শেষের দিকে পানি শুকানোর সময় তিতাস নদীতে মাছ শিকার করতাম, ঝড়ের দিনে দল বেঁধে আম কুড়াতাম, ট্রেন সান্টিঙ্গের সময় গার্ডের বগিতে চড়ে চলে যেতাম বড়বাজার গেইট পর্যন্ত, মহরম মাসের দশ তারিখে লাঠি খেলা দেখার জন্য দল বেঁধে চলে যেতাম খরমপুর স্কুল মাঠে, আরও কত কী। সেই শৈশবকালের বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠছে। আমি অস্থিরচিত্তে বার বার ঘড়ি দেখছি, কিন্তু গন্তব্যে যেতে এখনো অনেক সময় বাকি।
অবশেষে দুপুর ১২ টার মধ্যেই আমি আখাউড়া পৌঁছি। অতঃপর আমরা “আখাউড়া রেলওয়ে স্কুল” প্রাঙ্গনে মিলিত হই। দীর্ঘ ৪৪ পর আমাদের এই মিলন ছিল সত্যিই অবিশ্বাস্য!! আমরা আবেগআপ্লুত হয়েপরি। কিছুক্ষনের জন্য হলেও আমরা ফিরে যাই শৈশবকালে । আর স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকি। আলাপের এক পযার্যে জানতে পারি, বন্ধুবর জাহাঙ্গীর আলম প্রায় তিন বছর যাবৎ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে মিন্টুর সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছে। আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এতদিন ব্যাপারটি গোপন রেখেছে! মিন্টু বর্তমানে কুমিল্লা শহরের চকবাজার এলাকায় হার্ডওয়ারী ব্যবসা করছে। সে দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ সৌদী আরবের জেদ্দা শহরে মাছ ও সব্জীর ব্যবসা করেছে। ব্যক্তিগত জীবনে মিন্টু এক পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের জনক। কথা প্রসঙ্গে জানাগেল, বন্ধুবর জাহাঙ্গীর আলমও এক সময় সৌদী আরবের জেদ্দা শহরে একটানা ১৭ বছর অবস্থান করেছিল; কিন্তু ঠিকানা না জানার কারণে মিন্টু সাথে কখনো যোগাযোগ করতে পারেনি। ব্যাপরটি চমৎকৃতও বটে।
রেলওয়ে স্কুল প্রাঙ্গনে বেশ কিছুক্ষন অবস্থান করার পর আমরা বের হয়েপরি শৈশবের স্মৃতিবিজরিত জায়গাগুলো দেখতে। প্রথমেই আমরা ছুটে যাই খরমপুরের হযরত শাহ পীর কল্লা শহীদ(রা.)-এর মাজার প্রাঙ্গনে। তারপর কুমাড়পাড়া কলোনী, পশ্চিম কলোনী, পূর্ব কলোনী, স্টেশন কলোনী সহ বিভিন্ন এলাকাতে। এসময় আমরা বেশ স্মৃতিকাতর হয়েপরি। আমাদের জমজমাট আড্ডা চলে প্রায় ৫/৬ ঘণ্টা পর্যন্ত। কিন্তু জরুরি কাজের জন্য মিন্টু আখাউড়ায় অবস্থান করতে পারেনি। অতঃপর আমরা যার যার গন্তব্যে প্রত্যাগমন করি। আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে, একে একে শৈশব-কৈশোরকালের অনেক বন্ধুদেরকে ফিরে পাচ্ছি। আশা করছি, এখন থেকে আমাদের এই বন্ধন হবে আরো সুদৃঢ়।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ: দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized