বাঙালির একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে ভোরে খালি পায়ে প্রভাত ফেরি আর `আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি` গান অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু এখন একুশের সেই আবেগ আর ঐতিহ্য বাদ দিয়ে রাত ১২ টা ১ মিনিটে ইংরেজি নিয়মে প্রভাত ফেরি করা হচ্ছে, যা ভাষা দিবসের মূল চেতনার ওপর চড়ম আঘাত । এই সংস্কৃতি একুশের চেতনার সঙ্গে যায় না।
বস্তুত, অমর একুশ বাঙালির ইতিহাসে শুধু একটি তারিখ নয়; একুশ হলো একটি চেতনার বীজমন্ত্র। একুশকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার এক অবিনাশী চেতনার জন্ম হয়েছিল। আর এই চেতনার পথ ধরেই ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যূত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং ১৯৭১-এ আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
একুশ আমাদেরকে সামনে এগিয়ে চলার সাহস জোগায়। একুশের ভোরে ফুল হাতে নগ্ন পায়ে প্রভাত ফেরি আমাদের প্রেরনা দেয় সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার। একটি আমাদের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রাকে আরও সুদৃঢ় করে।
অবাক হওয়ার বিষয়, নাগরিক জীবনে একুশের এই আবেগকে খন্ডিত করে ফেলা হয়েছে! প্রায় তিন দশক আগে এক সামরিক শাসক নিজের নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় একুশের প্রথম প্রহর নাম দিয়ে রাত ১২ টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পনের রেওয়াজ চালু করে। একে বিনা প্রশ্নে মেনে নেয় নগরবাসী, সংস্কৃতিকর্মীসহ সর্বশ্রেণির মানুষ! আর সেই সঙ্গে একুশের চেতনায় জড়িয়ে থাকা প্রভাত ফেরি নতুন প্রজন্মের নিকট অচেনা হয়ে যায়।
অথচ বায়ান্নের পর থেকে একুশের প্রত্যূষে প্রভাত ফেরির মধ্য দিয়ে শহিদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন একুশের মহিমাকে আলাদা উজ্জ্বল্য দিয়েছে। কাকডাকা ভোরে সাজ সাজ রব। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পাড়ামহল্লার ক্লাবকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ ফুল হাতে নগ্ন পায়ে এগিয়ে যেত শহিদ মিনারের দিকে; কন্ঠে থাকতো `আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি` গানের সুর মূর্ছনা। এক অপর্থিব পরিবেশ সৃষ্টি করতো। এভাবে অমর একুশ যেকোনো জাতীয় দিবস থেকে আলাদা মাত্রা হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছিল।
ভাষা শহিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম প্রভাত ফেরিতে এমন আমূল পরিবর্তন সত্ত্বেও আমাদের নাগরিক জীবনের বাইরে গ্রাম-গঞ্জে আজও বাঙালিরা একুশের শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রভাত ফেরির মধ্য দিয়ে। একুশের প্রভাতে নিরবমিছিলে এর গানের সুর মূর্ছনা বাঙালিকে কৌতূহলী ও আবেগাপ্লুত করে তুলে। তাদের মাঝে ভাষাপ্রেম ও দেশপ্রেম জাগ্রত হয়।
এখন একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলাদেশের গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করছে বিশ্বাবসী। এই ভাষা দিবসে বিশ্ববাসী একবার ফিরে তাকাবে ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার বাংলাদেশের দিকে। অনুকরণ করবে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলির রীতি-রেওয়াজকে।
মূলত প্রভাত ফেরি শব্দটির জন্মই হয়েছে একুশে প্রভাতের নিরব মিছিলকে বোঝাতে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এর উৎসভূমির অনুকরণে বিশ্ববাসীও প্রভাত ফেরিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে। অথচ আমরাই হঠকারী সিদ্ধান্তে ভোরের প্রভাত ফেরিকে বিসর্জন দিয়ে মধ্যরাতে একুশে চেতনাকে খুঁজে ফিরছি। নিঃসন্দেহে সংস্কৃতিভাবনার সুস্থ ধারা বলবে, আমরা একুশের প্রভাত ফেরিকে হারাতে চাই না। হারাতে চাই না একুশের অনুভূতিকে। রাত ১২ টা ১-এর পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করে আবার সূর্যোদয়ের সময়কার প্রভাত ফেরির একুশে উদযাপনে ফিরে যেতে চাই। কারণ একুশকে তাঁর স্বমহিমায় পুনঃস্থাপন না করা গেলে নতুন প্রজন্মকে ভাষা প্রেমে উদ্বুদ্ধ ও জাগরিত করা যাবে না। বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশপ্রেমের জন্ম হয় তাঁর ভাষা প্রেমের মধ্য থেকেই।
লেখক : খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized