রোজা ফারসি শব্দ। এর অর্থ উপবাস থাকা। আরবী ভাষায় এটিকে সাওম বা সিয়াম বলা হয়। শরিয়তের পরিভাষায়, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাওয়া, পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাকে সাওম, সিয়াম বা রোজা বলা হয়।
এই রোজা কেবল উম্মতে মুহাম্মাদির জন্যই ফরজ নয়, বরং তা অতীত নবী-রাসূলদের উম্মতদের জন্যও আবশ্যক ছিল। কিন্তু সময়, পদ্ধতি ও ধারা ভিন্ন ছিল। এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বালেছেন, “হে মুমিনগণ তোমাদের জন্য সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য; যাতে তোমরা আল্লাহভীতি অর্জন করতে পারো।”(সুরা বাকারা:১৮৩)।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ(সা.) রজব ও শাবান মাস থেকেই রমজানের প্রস্তুতি নিতেন। রমজানের জন্য নিজেকে তৈরি করতে শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখতেন। রমজানের রোজা মহানবী(সা.) এর নবুওয়াতের পর পরই ফরজ করা হয়নি। বরং এটি দ্বিতীয় হিজরি সাল থেকে ফরজ করা হয়। তবে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ওয়াজিব ছিল, যা পরবর্তী সময়ে নফলে পরিনত হয়।
কথিত আছে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর একটি স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখতে মাহে রমজানের রোজা মুসলমানদের উপর ফরজ করা হয়েছে। গবেষকদের মতে, নবুওয়াত প্রাপ্তির আগে রমজান মাসে বেশ কিছুদিন হযরত মুহাম্মদ(সা.) হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন। দিনের বেলায় পানাহার করতেন না আর রাতে আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকতেন। তাঁর এই ইবাদত-বন্দেগী আল্লাহর কাছে এত পছন্দনীয় হয় যে, ওই ইবাদত কাটানো দিনগুলো স্মরণীয় করে রাখতে রাসূলের উম্মতদের ওপর রমজান মাসের রোজা ফরজ করে দেওয়া হয়।
এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, “রমজান মাস, এ মাসেই কোরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য হেদায়াত, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে, সে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ চান তোমাদের জন্য সহজ করতে, তিনি এমন কিছু চান না যা তোমদের জন্য কষ্টকর।”(সুরা বাকারা: ১৮৫)।
বস্তুত, রমজান মাসের রোজা উম্মতে মুহাম্মদির জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। যেমন এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার প্রতি আমাদের ঈমান ও বিশ্বাস প্রকাশ পায়। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি আর্জন করা যায়। অন্যের প্রতি সাহানুভূতি ও মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়। সংযম, ত্যাগ, দান, ভ্রাতৃত্ববোধ, দয়াসহ অন্যান্য চারিত্রিক গুণের বিকাশ ঘটে। দৈহিক, মানসিক, আত্মিক প্রশান্তি অর্জিত হয়। সহমর্মিতা, মমত্ববোধ ও কল্যাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়। অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকা হয়। ধনীদের মধ্যে গরিব, মিসকি দের সাহায্য করার উৎসাহ সৃষ্টি হয়।
কিন্তু মানুষকেই এসব গুণাবলী সব সময়েই অটুট রাখতে হবে। কারণ শুধু রমজান মাসের ক্ষণিকের তরে ইবাদত-বন্দেগি করে সৃষ্টিকর্তার প্রিয় হওয়া মানুষের পক্ষে খুবই দুস্কর ও কঠিন ব্যাপার বটে। আল্লাহর প্রিয় হতে হলে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ইবাদত-বন্দেগি করতে হবে। সব সময় খেয়াল রাখতে হবে রমজান চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন, ইবাদত-বন্দেগি ফুরিয়ে না যায়। আরো খেয়াল রাখতে হবে ইবাদত-বন্দেগির সঙ্গে আয়-উপার্জনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যেকোনো ইবাদত আল্লাহর কাছে গৃহীত হওয়ার জন্য বৈধ উপায়ে উপার্জন করা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। যদি কারও উপার্জনের উৎস অবৈধ হয়, পবিত্র রমজান মাসে তিনি যতই ইবাদত-বন্দেগি, দান-সদকা, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার করুন না কন-আল্লাহর কাছে তার কোনো মূল্য নেই। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ” হে মানবমন্ডলী! পৃথিবীতে যা আছে তা থেকে হালাল ও পবিত্র বস্তুসামগ্রী গ্রহন করো এবং শয়তানের অনুসরণ করিওনা। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।”(সূরা বাকারা:১৬৮)
ইসলামি গবেষকদের মতে, সে জাতি বড়ই হতভাগ্য, যারা কেবলমাত্র রমজানেই আল্লাহ ও বান্দার হক সম্পর্কে সচেতন থাকে। যে ব্যক্তি সারাবছর ঠিকমতো ইবাদত-,বন্দেগি করে সেই সফল নেককার। এই প্রসঙ্গে কোরআনে করিমে ইরশাদ হচ্ছে, “তুমি মৃত্যু আসা পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করতে থাকো।”(সুরা হিজর:৯৯)।
বস্তুত, প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে বান্দা আল্লাহতায়ালার কোনো না কোনো নেয়ামতে ডুবে থাকে। প্রকৃত মুমিন বান্দার জীবনে এমন কোনো মুহূর্ত অতিবাহিত হয় না, যে সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত কোনো না কোনো দায়িত্ব না থাকে। প্রকৃত মুমিন বান্দা সব সময় আশা ও ভয়ের মধ্যে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে তার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে।
আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই দেখা যায় যে, বেশিরভাগ মানুষ শুধু রমজান মাসেই ইবাদত-বন্দেগিতে ব্যস্ত থাকে আর অন্য মাসে ইবাদত-বন্দেগিতে সময় ব্যয় করে না! কিন্তু ইসলামী দর্শন তা মোটেই সমর্থ করে না। ইসলামি দর্শন মতে, প্রতিটি মানুষের উচিত রমজান মাসের মতো নামাজ,যাকাত ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি বাকি এগারো মাসে অব্যাহত রাখা। কেননা যিনি রমজান মাসের রব্ব, বাকি এগারো মাসের রব্ব তিনিই; তিনিই ইহকাল ও পরকালের অধিকর্তা।
বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ইবনে রজব(রাঃ)-এর মতে, কোনো ব্যক্তি রমজানের পরপরই হারাম ও গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়ে গেলে, তার রোজা স্বীয় মুখের ওপর নিক্ষেপ করা হয় এবং তার রহমতের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। গোনাহের পর ভালো কাজ করা কতই না উৎকৃষ্ট আমল। কিন্তু তার চেয়ে আরো উৎকৃষ্ট আমল হলো-নেক কাজের পর আরেকটি নেক কাজে মশগুল হওয়া এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত উক্ত নেক কাজ অব্যাহত রাখা।
আজ ১৪ রমজান ১৪৪৪ হিজরী। ধীরে ধীরে এ মাস বিদায় নিতে যাচ্ছে। আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি কতটা অপরাধমুক্ত হয়ে উঠেছে? কতটা সভ্য, ভদ্র ও নৈতিক মূল্যবোধে তৈরি হয়েছে আমাদের চেতনা-বিশ্বাস? শুধু ইফতার ও শেহেরীতে লোভনীয় খাবার খেয়ে ও তারাবি নামাজ আদায় করে রোজা পালন করলেই চলবে না। নিজের বদআমল গুলি পুড়ে ছারখার করে নিজেকে পরিশুদ্ধ ও নির্মল করতে হবে। নিজের মধ্যে খোদাভীতি, ধৈর্য, সহনশীলতা, ত্যাগ, সহমর্মিতা, পরোপকার ইত্যাদি গুণাবলী অর্জন করতে হবে। মূলত রমজান হলো আত্মশুদ্ধি, ত্যাগ ও প্রশিক্ষণের মাস। সেই আদিকাল থেকেই রোজা মানুষের আত্মশুদ্ধি ও পরিশুদ্ধের পথ হিসেবে প্রচলন হয়ে আসছে।
সুতরাং রমজান মাসের এই আত্মশুদ্ধির চর্চা সারা বছরই অনুসরণ করতে হবে; শুধু রমজানে তা সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। যদি আমরা আত্মশুদ্ধি ও পবিত্র হওয়ার চর্চা সারা বছর অব্যাহত রাখতে পারি, তাহলে একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়ে ওঠাসম্ভব।
নৈতিক অবক্ষয়ই বর্তমান মুসলিম বিশ্বের প্রধানতম সমস্যা। আজ মুসলিম মিল্লাতের উচিত চারিত্রিক অধঃপতন থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করা এবং নেতিয়ে পড়া চেতনাকে জাগ্রত করা। নৈতিকতার উৎকর্ষ সাধনই হোক এবারের মাহে রমজানের অঙ্গীকার।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ : দেশ দর্শন
Some text
ক্যাটাগরি: Uncategorized