“আজ পেঁয়াজের দাম বাড়ে তো কাল তেলের দাম বাড়ে। পরশু গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বাড়ে, এর পরদিন আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ে। সব উর্ধ্বমুখীর মাঝে নিম্নমুখী শুধু আমাদের আয়। যে হারে আর দ্রুততার সঙ্গে সবকিছুর দাম বাড়ছে তাতে মনে হয়, ১৯৭৪-এর মতো আবার দেশে দুর্ভিক্ষ হবে।”
বেড়েই চলছে ভোজ্যতেল, চাল, চিনি, পেয়াজ, সবজি, আটা, মাছ, মুরগিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম। একে একে সবকিছুর দাম নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নাগালের একেবারে বাইরে চলে যাচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে নজরদারির নামে দফায় দফায় যদিও চলছে অভিযান, জরিমানা। পণ্যের মূল্যও বেধে দিচ্ছে সরকার। কিন্তু কিছুতেই দামের লাগাম টানা যাচ্ছে না। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অস্থির হয়ে উঠছে ভোগ্য পণ্য ও নিত্যপ্রয়েজনীয় বাজার।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকায় রয়েছে ১০/১২টি কাঁচা বাজার। সরেজমিনে দেখা যায়, মধ্যপাড়া এলাকার বর্ডার বাজারে সবজি বিক্রেতাদের বিক্রি আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। পৈরতলার বাসিন্দা সবজি বিক্রেতা লোকমান হোসেন জানান, শীতকালে হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ার করণে জমির বেশিরভাগ ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই সবজির দাম বেড়ে গেছে। গত বছর এ সময় টমেটোর দাম ছিল প্রতি কেজি ১০ থেকে ১৫ টাকা। এখন এর দাম প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
সিমের বিচির দাম ছিল প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, এবার তা বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ৮০ টাকা। ফুলকপির দাম ছিল ১০ থেকে ১৫ টাকা, এবার এর দাম ৩০ থেকে ৪০ টাকা। মাছ কিনতে আসা বসির মিয়া জানায়, তার বাড়ি শেরপুর। পেশাগতভাবে সে রিকশা চালক। ছেলে-মেয়ে সহ চার পরিবারের সদস্য। গত বছরের তুলনায় এবার মাছের দাম বেশি হওয়ার কারণে মাছ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। তার কাছ থেকে আরো জানা গেল, গত বছর তেলাপিয়ার প্রতি কেজি ছিল ১৪০ টাকা, পাঙ্গাসের প্রতি কেজি ছিল ১০০ টাকা। এবার সেই তেলাপিয়া প্রতি কেজি ১৮০ টাকা, পাঙ্গাস প্রতি কেজি ১৩০ টাকা। এ রকম সব জাতের মাছের দাম বাড়ছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “আমরার বুঝি বাছনের পত নাই।”
শহরের তিতাস নদীর গাঁ ঘেষেই আনন্দ বাজার। বাজারটি বেশ পুরানো। মূলত এখান থেকেই যাবতীয় সবজি, মাছ, চাল, আটাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য শহরের বিভিন্ন বাজারে খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট পাইকারীভাবে বিক্রি করা হয়। বস্তুত আনন্দ বাজরের আরৎদারারই পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
আনন্দ বাজরের বেশ পুরানো ব্যবসায়ী মেসার্স শরিফ ট্রেডার্সের মালিক মোঃ বাহাউদ্দীনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত মাসে প্রতি লিটার (বোতলজাত) সয়াবিনের দাম ছিল ১৬০ টাকা, বর্তমানে এর মূল্য প্রতি লিটার ২০০ টাকা। আটা ছিল প্রতি কেজি ৩০ টাকা। সেই আটা এখন প্রতি কেজি ৩৫ টাকা। পেঁয়াজের দাম ছিল প্রতি কেজি ৩৫ টাকা। সেই পেঁয়াজের বর্তমান মূল্য ৪০ টাকা। মোটকথা, সব ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে। এজন্য দায়ী আমদানীকারকরা। কিন্তু সরকার মোবাইকোর্ট দ্বারা আমাদেরকেই শুধু জরিমান করছে। চাহিদা ও সরবরাহের উপর নজর না রেখে আমাদের মতো খুচরা বিক্রেতাদের উপর চলছে অভিযান-জরিমানা। এতে সমস্যার সমাধান না হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
তিনি আরো বলেন, এসব দায়সারা অভিযান বাদ দিয়ে সমস্যার মূলে হাত দিতে হবে। পণ্যের সরবরাহ না বাড়িয়ে যতই মূল্য নির্ধারণ ও তদারকি অভিযান চালানো হোক না কেন, দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে না। পাশাপাশি বাজারসংশ্লিষ্ট সরকারি মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। এমন সময় সেখানে মাসিক মুদি বাজার করতে আসে মনির হোসেন সরকার নামে এক ব্যাংকার। তিনি বলেন, আজ পেঁয়াজের দাম বাড়ে তো কাল তেলের দাম বাড়ে। পরশু গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বাড়ে, এর পরদিন আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ে। সব উর্ধ্বমুখীর মাঝে নিম্নমুখী শুধু আমাদের আয়। যে হারে আর দ্রুততার সঙ্গে সবকিছুর দাম বাড়ছে তাতে মনে হয়, ১৯৭৪-এর মতো আবার দেশে দুর্ভিক্ষ হবে।
শহরের আরেকটি ভোগ্য পণ্যে বাজার হলো হুক্কা পট্টি। এখানে রয়েছে শাহজান স্টোর, দয়াল স্টোর, সুমন্ত ট্রেডার্স, আক্তার স্টোর নামে বেশ কয়েকটি মুদি দোকান। সব দোকানেই ক্রেতারা শুধু সয়াবিন তেল খুঁজছেন, কিন্তু কোথাও পাচ্ছেন না। তবে কোনো ক্রেতা যদি অধিক টাকার মালপত্র ক্রয় করেন তখনই তিনি সয়াবিন তেল পাচ্ছেন! দয়াল স্টোরের বিপরীত পাশে রয়েছে রতন টি স্টল। এর মালিক তপন ঠাকুর বলেন, চিনি, চা পাতা, জ্বালানি তেলসহ কনডেন্সড মিল্কের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু আমরা এখনো চায়ের দাম বাড়াতে পারিনি। ফলে সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে।
হুক্কা পট্টির লাগোয়া জগৎ বাজার। এখানে রয়েছে মেসার্স শাহীন স্টোর, মেসার্স খায়েশ স্টোর, মেসার্স কাউসার স্টোর, মেসার্স জাকারিয়া স্টোরসহ আরো কিছু মুদি দোকান। এখানকার ব্যবসায়ীদের মতে, শোনা যাচ্ছে সরকার তেল, চিনি, পেঁয়াজ, ডাল, ময়দা, আটাসহ বেশকিছু পণ্যের আমদানিতে আরোপিত ট্যাক্স-ভ্যাট মওকুফ করবে। হয়তো তখন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে দাম কমবে।
সরেজমিনে আরো দেখা যায়, কারো দোকানেই সয়াবিন তেল নেই! তাদের অভিমত, সয়াবিন তেলের ডিলাররা চাহিদা অনুযায়ী তাদেকে মাল দেয় না। সুতরাং চাহিদা বেশি থাকার কারণে ভোজ্যতেল দোকানে আনার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে যায়। এখানকার প্রতিটি দোকানে রয়েছে মালপত্র বহন করার জন্য শ্রমিক। তাদের কামলা বলা হয়। তাদেরই একজনের নাম প্রাণ কৃষ্ণদাস। বাড়ি ভাদুঘর। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “চাল, ডাল, তেল, নুন, গ্যাস- সবকিছুরই দাম বাড়ছে। তবে আমাদের মজুরি বাড়ছে না। অহন পোলাপাইন ও বউরে লইয়া খুব কষ্টের মধ্যে আছি। এই টাহায় জীবন চলে না।”
এক কথায় বলা চলে, বাজারে নিত্যপণ্যের দামের উর্ধ্বগতি দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য অপ্রত্যাশিত দুর্ভোগরূপে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় আর বাস্তব আয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক বিদ্যমান। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও মানুষের আয় বৃদ্ধি পায়নি। পণ্যের চাহিদানুযায়ী উৎপাদন বা সরবরাহ কম থাকলে সাধারণত পণ্যের দাম বাড়ে। কিন্তু আমাদের দেশে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আসছে একধরনের অসাধু চক্র। তারা যখন খুশি তখনই পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নিজেদের ইচ্ছামতো মুনাফা লোটে।
ভুক্তভোগীদের অভিমত, পর্যাপ্ত পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা, ভোক্তাবান্ধব বাজারব্যবস্থা এবং কৃত্রিম সংকট তৈরির সঙ্গে জড়িত অসাধু চক্রকে আইনের আওতায় আনতে সরকারের সুদৃষ্টি প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন, নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ে প্রশাসনের কড়া নজরদারী।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন ডটকম
ক্যাটাগরি: অপরাধ-দুর্নীতি, প্রধান খবর, বিশেষ প্রতিবেদন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শীর্ষ তিন