আমাদের অবিভাবকগণ মোটেও সচেতন নয়। সন্তান কতটুকু শিখছে, কী শিখছে, তা তারা যাচাই করে দেখেন না। এই নিম্নমুখী শিক্ষা না পারে ভালো শিক্ষার্থী গড়ে তুলতে, না পারে উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি করতে। শুধু তাই নয়, সমাজে আদর্শ নাগরিক গঠনেও এই শিক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ।
‘শিক্ষা’র প্রকৃত সংজ্ঞা কী হতে পারে তা হয়তো এক কথায় প্রকাশ করা যাবে না। শিক্ষা হচ্ছে তাই, যা একটি মানব সমাজকে সভ্যতা, সুশিক্ষা ও মনুষ্যত্বে বিকশিত করে। সহযোগিতা-সহমর্মিতা সুশৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে। জীবনমান উন্নত করে। পৃথিবীতে একটি অখণ্ড জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। অক্ষরজ্ঞান থাকা কিংবা লেখাপড়া জানা আর শিক্ষা এক কথা নয়। একটি জাতি শিক্ষাকে কতটুকু ধারণ ও লালন করতে পারে তা নির্ভর করে জাতির শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। ‘শিক্ষাব্যবস্থা’-এই কথার সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও জড়িত।
শিক্ষার মানোন্নয়নে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ব্যক্তির ভূমিকাও প্রায় ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। ‘নানা ঋষির নানা মত’- শিক্ষার অনবদ্য এ চেতনাগত দিকটির কারণে একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন মতাদর্শ, বিভিন্ন দল, গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর দায় কিন্তু সরকার ও ‘শিক্ষাসিলেবাস’ প্রণয়নে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণের উপর। শিক্ষানীতি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, চাহিদা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্মের সাথে সামাঞ্জস্য রেখে প্রণয়ন করা উচিৎ।
আমাদের জীবন, শিক্ষা-সংস্কৃতি নিয়ে সরকারের ভাবা উচিত। জনমানুষের জীবনমান, প্রজন্মের শিক্ষা উন্নয়নে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে। উন্নত বিশ্ব থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোতে বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বেশি রাখাটা অনেক জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। সত্যিকারের নৈতিক ও মানবিক চৈতনাসম্পন্ন মানুষ যেন আমরা পেতে পারি সে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
আমাদের অবিভাবকগণ মোটেও সচেতন নয়। সন্তান কতটুকু শিখছে, কী শিখছে, তা তারা যাচাই করে দেখেন না। এই নিম্নমুখী শিক্ষা না পারে ভালো শিক্ষার্থী গড়ে তুলতে, না পারে উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি করতে। শুধু তাই নয়, সমাজে আদর্শ নাগরিক গঠনেও এই শিক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ। দিন দিন মানুষের চিন্তা-চেতনা, ভাবনার গণ্ডি সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ বেড়ে যাচ্ছে। জুলুম, খুনোখুনি, দুর্বলের প্রতি সবলের আধিপত্য ইত্যাদির প্রতিনিয়ত সাক্ষী হচ্ছে গণমাধ্যম।
শিক্ষার মানোন্নয়নে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ব্যক্তির ভূমিকাও প্রায় ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। ‘নানা ঋষির নানা মত’- শিক্ষার অনবদ্য এ চেতনাগত দিকটির কারণে একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন মতাদর্শ, বিভিন্ন দল, গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর দায় কিন্তু সরকার ও ‘শিক্ষাসিলেবাস’ প্রণয়নে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণের উপর।
শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে নতুন নতুন শিক্ষানীতি কতটুকু উপকার করেছে? সরকারের ভালো শিক্ষানীতির সাফল্য না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, যারা শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা দিচ্ছেন তারা নিজেরাই শিক্ষার্থীদেরকে বিষয়গুলো বুঝাতে পারছেন না। ফলে সৃজনশীল কার্যক্রমের বদলে পুরোনো আদিম যুগের মুখস্থ বিদ্যাতেই রয়ে গিয়েছে শিক্ষার্থীরা। আর যা নতুন করে সংযোজন করা হয় তা সম্পূর্ণ নৈতিকতা ও আদর্শ বিরোধী।
একটা সদ্যোজাত শিশু যখনই কথা বলতে শেখে, বাবা-মা উন্নত ভবিষ্যত এর চিন্তায় তাদেরকে নিয়ে হাজির হন কিন্ডারগার্টেন কিংবা চাইল্ড কেয়ার এর মতো নানান প্রতিষ্ঠানগুলোতে। শুরু থেকেই বাচ্চাদের বুঝানো হয়- তোমাকে ১০০ তে ৯৯ পেতে হবে। প্রাথমিকের মোটামুটি শেষ পর্যায়ে শুরু হয় আরেকটি চ্যালেঞ্জ। তারপর পিএসসি, জিএসসি, এসএসসি, এইচএসসি। পেতে হবে গোল্ডেন জিপিএ। কিন্তু নিজের সন্তান কতটুকু শিখতে পারলো, তার প্রচেষ্টা কারো নেই। পড়, মুখস্ত করো, পরীক্ষার খাতায় লিখো আর জিপিএ এনে দাও। এভাবেই চলে আসছে। সেই মুখস্থ বিদ্যার পরিত্রাণ ঘটাতে সরকার শিক্ষানীতিতে পরিবর্তন এনে সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু তারপরও সন্তোষজনকভাবে শিক্ষার মেধা বিকাশ ঘটেনি। ফলে আমরা রয়ে গিয়েছি- আই এ্যাম জিপিএ ফাইভ (I am GPA 5) দুনিয়ায়। শিক্ষা শুধু সার্টিফিকেটেই থাকছে, শিক্ষার্থীর ব্রেইনে নয়। ফলাফল, দেশে দক্ষ জনবলের অভাবে দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থান পায় বিদেশিরা।
বিশ্বের অগ্রগণ্য অর্থনীতির একটি দেশ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। তবে তার জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো এবং শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিতের বিষয়টি শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন। প্রগতিশীল বিশেষজ্ঞরা সেই পথিকৃৎ জায়গাটায় কতটুকুই বা হাঁটছেন?
আমানুল্লাহ মুর্তজা
সংবাদকর্মী
ক্যাটাগরি: অপরাধ-দুর্নীতি, মিনি কলাম, শীর্ষ তিন