বাজারটির নাম বাইশমৌজা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার অন্তর্গত বীরগাঁও ইউনিয়নে মেঘনা নদীর তীরের ঐতিহ্যবাহী এই বাজারটির বয়স প্রায় ২০০ বছর। পাঁচ বিঘা জমির এই বাজারটির নাম ছিল আছি মাহমুদের বাজার। বাজারটি নিয়ে মেঘনা নদীর অপর পাড়ের আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুরের সাথে বাইশমৌজা পার্শবর্তী এলাকার বিবাদ লেগেই থাকত। স্বাধীনতার দু’বছর পর সম্মিলিত সিদ্ধান্তে নবীনগর উপজেলায় মেঘনা নদীর তীরে এই বাজারের নামকরণ করা হয় ‘বাইশমৌজা বাজার’। এবং স্থায়ী ভাবে বাজারটি নবীনগরের এরিয়ায় চলে আসে।
উপজেলার বীরগাঁও ও কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের সম্মিলন করে এর নামককরণ করা হয় বাইশমৌজা বাজার। সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার বসে এটি। এই সাপ্তাহিক হাটে আসে কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা। এছাড়া সাধারণ ক্রেতা তো আছেই।
বাজারটিতে যাতায়াতের একমাত্র বাহন হলো নৌকা। যেদিক দিয়ে যাওয়া হোক না কেন নৌকা ছাড়া উপায় নেই। মানুষ, পশু ও মালামাল একই নৌকায় আনা নেওয়া করছেন মাঝিরা। সম্প্রতিকালে ব্রীজ-সড়ক যোগাযোগের কাজ চলছে দ্রুত। আগামী ছ মাসের মধ্যে এটি চালু হবে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তাগন। এটি চালু হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জের মানুষ সহজে যাতায়াত করতে পারবেন। দূরদূরান্ত থেকে বড় নৌকা ও ট্রলারে পাইকাররা গরু, মহিষ, ভেড়াসহ বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে আসেন। বাজারে ঢুকার সময় চোখে পড়ে নদীর তীরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো বড়-ছোট নৌকা। ক্রেতাদেরও পশু ও মালামাল নিয়ে ফিরে যেতে হয় নৌকা দিয়ে নদী পথে।
বাজারটি মঙ্গলবার জমজমাট বেশি থাকে মূলত গরুর বাজারকে কেন্দ্র করে। এইদিনে থাকে ক্রেতা বিক্রেতাদের বিপুল সমাগম। দূর দূরান্ত থেকে আসেন পাইকাররা। বাজারটি বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা। যেমন-গরু বাজার, মহিষ-ছাগলের বাজার, কাঠের বাজার, পাখির বাজার, মসলার বাজার, শুটকির বাজার, মাছ ধরার জালের বাজার, হাঁস-মুরগীর বাজার, পাটের বাজার, সবজির বাজার, বাদামের বাজার। বাজারটির বেশির ভাগ অংশ জুড়ে আছে গরু, মহিষ ও ছাগলের হাট বা বাজার।
ক্রেতাদের ধারণা জেলার অন্যসকল হাট থেকে এখানে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া অনেকটা কম দামে পাওয়া যায়। হাসিল (রোয়ানা) দিতে হয় নামমাত্র টাকায়। বাইশমৌজা বাজারে গরু ও মহিষের হাট বসে পৃথকভাবে। গরুর হাটের দেখা যায় বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে আসা বড় বড় গরু বিক্রয়ের জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো আছে। বাজারে অল্প দামের গরুও মজুদ রয়েছে। তবে দেখলে বিস্মিত হওয়ার মতো এমন একেকটার দাম ৮০ হাজার থেকে প্রায় ২ লাখ টাকা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। এরচেয়ে বেশি দামের গরু মহিষ সরবরাহ করে পাইকাররা। ছোট ও মাঝারি সাইজের গরুও আছে অনেক। গাভী, ছোট ষাঁড়বাছুর, মাদীবাছুর ও খাসি-ভেড়ার জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক জায়গা।
বাজারের ইজারাদারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত কেনাবেচার পরিমাণ ১৫ থেকে ২০কোটি টাকা। কিন্তু ঈদুল আজহা এলে এর পরিমাণ আনুমানিক দশগুণ বেড়ে যায়। এরচেয়ে বশি ও হয়। সেই হিসেবে ২৫০থেকে ৩০০কোটি টাকার পশু গতমঙ্গল বারে বেচাকেনা হয়ছে বলে ধারনা করেন বাজার কমিটি।
বাজারে কাঠের তৈরি বিভিন্ন ফর্ণিচার ও পাওয়া যায়। নৌকা, দরজা, চৌকি, একাশি, মেহগনি ও পাথুরে কড়ই গাছের খাট বিক্রি হয় সুলভ মূল্যে। ফার্ণিচার বিক্রতা জনাব শাহ্ মুর্তুজ আলী জানিয়েছেন তার জীবনের গল্প, তিনি বলেন, “আমি গত চল্লিশ বছর যাবৎ ফার্নিচারের কাজ করছি। শ্রমিক দিয়ে করিয়েছি। কাজের সুনাম আছে। আমার কোনো জুড়ি নেই। এখন শুধু লাঙল বিক্রি করি। এ ব্যবসা আমার আগেও ছিল। আব্বার কাছ থেকে লাঙল বানানো শিখেছি। কাজের নৈপুণ্যতায় মানুষের কাছ থেকে প্রশংসা পাই। অনেক দূর থেকে আমার কাছে লোক আসে। কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ, ইটনা, মিঠামৈন, কসবা, রায়পুরা। দূরাগত বিভিন্ন কাঠমিস্ত্রি আমার কাছ থেকে লাঙল বানানোও শিখেছে।’
আরেকটি জিনিসের জন্য বাজারটি বিখ্যাত। তা হচ্ছে শুকনো মরিচ। সাপ্তাহিক হাটের দিনে শনি-মঙ্গল বারে প্রচুর পরিমাণে লাল শুকনো মরিচ নিয়ে বিক্রেতারা আসেন। শুকনো মরিচ কিনতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা আসেন। আসেন বিভিন্ন প্যাকেট জাত মসলা কোম্পানির প্রতিনিধিরা। এমন কোনো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বাদ নেই এখানে পাওয়া যায় না। বেতের তৈরি ঝুড়ি, কুলা, ডুলা, হাতপাখা ও সব প্রকার মসলা, সবজি, পাখি, হাঁস-মুরগী, কবুতর, শুঁটকি, মাছ ধরার জাল, কাঠ, পাট, বাদামসহ আরো হরেক রকম মালামাল।
বাজারের মধ্যবর্তী জায়গায় বসে পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, আদাসহ নানান প্রকার মসলার বাজার। স্থানীয় কৃষক ও পাইকাররা মসলা সাজিয়ে বসেন বিক্রি করতে। দামও তুলনামূলক কম মসলার। তাই আশপাশের মানুষ সপ্তাহিক বাজারে মসলা ক্রয় করে নিয়ে যায় এই বাজার থেকে।
এর পাশেই পশ্চিম দিকে বসে শাক-সবজির বাজার। স্থানীয় কৃষকদের সবজিসহ পাইকারদের আনা সবজি বিক্রি করা হয় এখানে। সুলভ মূল্যে সকলেই কেনাকাটা করতে পারে। এখানে শুঁটকি নিয়ে আসেন মেঘনা নদীর অপর প্রান্তের আশুগঞ্জের লালপুরের ব্যবসায়ীরা।
অন্যান্য জায়গা থেকেও পাইকাররা বড় বড় মটকায় শুটকি নিয়ে আসে।মেঘনা নদীর শুঁটকির কদর অনেক বেশি এই অঞ্চলে। বাশঁমতি, লইট্টা, পুটি, ম্যানি, কাইক্কাসহ নানান জাতের দেশীয় শুঁটকি বিক্রি জন্য নিয়ে আসা হয় এই বাজারে।
বিচিত্র রঙের পাখি, হরেক প্রকার কবুতর,বেতের তৈরি মালামাল, মাছ ধরার জাল, পাট ও হাঁস-মুরগির বাজার বসে একটি অংশে। এর পাশের একটা অংশে বিক্রি করা হয় বাদাম। চাল ও ধানের জন্য রয়েছে বাজারের আলদা জায়গা।
বাজারের পশ্চিম দক্ষিণকোণে অংশ জুড়ে আছে কাঠের বাজার। মাঠের মধ্যে সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন গাছের কাঠ। বাড়িঘর, আসবাবপত্র ও নৌকা তৈরি করতে ক্রেতা কাঠ কিনে নিচ্ছেন। এছাড়াও বাজারের পশ্চিমে আছে লঞ্চঘাট। নবিনগর, ভৈরব দূরের বিভিন্ন জায়গায় সহজে যাতায়াত করা যায়। ঘাটের ডান পাশের জায়গাটা মূলবাজারের অংশ হিসেবে শীতকালীন কাচামালের পাইকারি কেনাবেচার বড় বাজার এটি। সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত পাইকারি কেনাবেচা চলে হরদম। শীতকালে দেখা যায় লাল লাল খাঁচা ভরা পাকা টমেটো। কাঁচা মরিচ, বেগুন, কইডা-কড়লা, ধনিয়া পাতা, স্তূপীকৃত গোল আলুও মিষ্টি কুমড়া।
প্রতিবেদক: আমানুল্লাহ মুর্তজা
বিশেষ প্রতিবেদক
ক্যাটাগরি: বিশেষ প্রতিবেদন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শীর্ষ তিন