অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রয়োজনে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে পুরানো কূপে ওয়ার্কওভার করা হোক। এতে খরচও কমবে এবং পুরানো কূপে অনেক গ্যাসও পাওয়া যাবে। দেশে এখনো ৪৮টি কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদন সম্ভব, কিন্তু সেগুলো ফেলে রাখা হয়েছে।
নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামের চাপে যখন সাধারণ মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, তখন জ্বালানি গ্যাসের দাম আরেক দফা বাড়ানোর প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। গত ২১ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত মোট চার দিনব্যাপী এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিদ্যুত ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর গণশুনানি সম্পন্ন করেছে। উক্ত শুনানিতে ভোক্তা মহলের প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে দাম না বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দেওয়া হলেও তা তেমন একটা আমলে নেওয়া হয়নি।
ওই শুনানিতে পেট্রোবাংলার আওতাধীন গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো বিভিন্ন হারে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো তাদের প্রস্তাবে এক চুলা ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা এবং দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১০০ টাকা নির্ধারণ করার কথা বলেছে। এছাড়া আবাসিক পর্যায়ে প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটারের বর্তমান মূল্য ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৭ টাকা ৩৭ পয়সা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছে। সিএনজি প্রতি ঘনমিটার ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৬ টাকা ৪ পয়সা, হোটেল-রেস্টুরেন্টে ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯ টাকা ৯৭পয়সা, ক্ষদ্র ও কুটির শিল্পে ১৭ টাকা ৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩৭ টাকা ২০ পয়সা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ১৩ টাকার ৮৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা ৯ পয়সা এবং চা শিল্পে ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৩ টাকা ২৪ পয়সা করার প্রস্তাব করেছে। আরো প্রস্তাব করা হয়েছে বিদ্যুৎ ও সার কারখানায় থাকা বর্তমান ৪ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৬৬ পয়সা।
উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রতিদিন তিন হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বাংলাদেশে সরবরাহ করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এরমধ্যে ২ হাজার ৩০০ ঘনফুট গ্যাস দেশীয় উৎস থেকে সরবরাহ করা হয়। বাকি ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি গ্যাস আমদানী করা হয়। তার মধ্যে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কেনা হয় ১০ বছরের দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তি ৬ থেকে ১০ ডলার মূল্যে। স্পট মার্কেট থেকে বাকি ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি গ্যাস কেনা হয়, যেটির দাম ওঠানামা করে। কিন্তু এই স্বল্প পরিমাণ গ্যাসের জন্য এখনই এতো বেশি মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক ও অমানবিক। বাস্তবে স্পট মার্কেট থেকে আনা গ্যাসের দাম বেড়েছে ৫-৬ শতাংশ। কিন্তু এ জন্য গ্যাসের দাম এত বেশি বাড়াতে হবে- এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যদি স্পট মার্কেটে গ্যাসের দাম কমে যায়, তখন কি গ্যাসের দাম কমবে?
বাণিজ্যিক ও আবাসিক উভয় ক্ষেত্রে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এমনকি ব্যাপক জনবিক্ষোভ ও জনবিস্ফোরণের আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বি ডি রহমতউল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেছেন, এখন গ্যাসের দাম বাড়ানো একেবারেই যৌক্তিক নয়। দেশের ভেতরে যে গ্যাস রয়েছে, সেটা সরকার তুলছে না। বরং বিদেশ থেকে আমদানীর উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। একটা চক্রকে ব্যবসা পাইয়ে দিতে ও বিশেষ সুবিধা দিতেই এটা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সহমত পোষণ করে দেশের আরেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রয়োজনে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে পুরানো কূপে ওয়ার্কওভার করা হোক। এতে খরচও কমবে এবং পুরানো কূপে অনেক গ্যাসও পাওয়া যাবে। দেশে এখনো ৪৮টি কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদন সম্ভব, কিন্তু সেগুলো ফেলে রাখা হয়েছে। এছাড়াও সিস্টেম লস কমাতে পারলে তা থেকে অনেকখানি চাহিদা মেটানো সম্ভব। কিন্তু সরকার সেই পথে হাটছে না। তাই কোনোভাবেই গ্যাসের দাম বাড়ানো উচিত হবে না।
বস্তুত বিইআরসি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কমিশন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করে আসছে। কমিশন হচ্ছে আধা বিচারিক ব্যবস্থা। কার্যত এখানে যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে গণশুনানির ৩০ দিনের মধ্যে মূল্যহার নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বিইআরসি যদি বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবে সাড়া দেয়, তাহলে জনজীবন, সমাজ ও অর্থনীাততে ব্যাপক বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। বাণিজ্যিক ও আবাসিক উভয় ক্ষেত্রে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এমনকি ব্যাপক জনবিক্ষোভ ও জনবিস্ফোরণের আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।
কারণ করোনা মহামারিতে কাজ হারিয়ে অনেক মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক সংকটের চিত্র সমাজ অর্থনীতির সব পর্যায়ে বিদ্যমান। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া উৎপাদন-বন্টনসহ মানুষের জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলবে।
খায়রুল আকরাম খান
ব্যুরো চীফ, দেশ দর্শন
ক্যাটাগরি: প্রধান খবর, শীর্ষ তিন