আমরা আশা করি, সাংবাদিকেরা অবাধে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা প্রায়ই যে বাণী দিয়ে থাকেন, তা নিছক কথার কথা হবে না। বাস্তবেও এর প্রতিফলন দেখতে চায় দেশের মানুষ।
বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকেরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যখন আইনি ও আইনবহির্ভূত নানামুখী বাধা ও হস্তক্ষেপের সম্মুখীন হচ্ছেন, তখন বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া দুটি খবর কিছুটা হলেও আশাব্যঞ্জক। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রেসিডেন্টের নির্দেশনা অনুসারে দীর্ঘদিনের চর্চায় পরিবর্তন এনে বিচার বিভাগ তথ্য ফাঁসের তদন্তে সাংবাদিকের তথ্যদাতার তথ্য জানতে তাঁকে আইনি বাধ্যবাধকতায় ফেলার চর্চা ভবিষ্যতে অনুসরণ করবে না।
অন্যদিকে ভারতে সাংবাদিক বিনোদ দুয়ার বিরুদ্ধে বিজেপির এক নেতার দায়ের করা দেশদ্রোহের মামলা খারিজ করে দিয়েছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। আদালত বলেছেন, ১৯৬২ সালের নির্দেশিকা অনুযায়ী দেশদ্রোহের মামলায় প্রত্যেক সাংবাদিকের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কেননা সরকারের সমালোচনা কোনোভাবে রাষ্ট্রদ্রোহ হতে পারে না। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় ক্ষমতাসীন বিজেপির জন্য যেমন বড় ধাক্কা, তেমনি সাংবাদিকদের জন্য স্বস্তির খবর।
সিএনএনের খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের এই নির্দেশনা আসার আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় বিচার বিভাগ নিউইয়র্ক টাইমস-এর চার সাংবাদিকের ই-মেইল তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছে, জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরও এই চেষ্টা অব্যাহত ছিল। যদিও গুগলের অনড় অবস্থানের কারণে তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি।
সরকার যদি ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে রচিত সংবিধান অমান্য না করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে চলে, তাহলে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় ও যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের ঘোষণা নিঃসন্দেহে সেখানকার সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ঝুঁকি কমাবে এবং সুরক্ষা দেবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, ভিন্ন দুটি দেশের আদালতের রায় ও বিচার বিভাগের ঘোষণার সঙ্গে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সম্পর্ক কী? সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে। সংবাদক্ষেত্রের তথা সাংবাদিকের স্বাধীনতা যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে আছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা ও সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
সরকার যদি ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে রচিত সংবিধান অমান্য না করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে চলে, তাহলে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে। সাংবাদিকের কাজ হলো জনগণের কাছে সঠিক তথ্যটি পৌঁছে দেওয়া। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ভুল হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু তথ্য সংগ্রহে তাঁকে বাধা দিতে পারেন না। তথ্যের উৎস জানানোর জন্য চাপও দিতে পারেন না।
কিছুদিন আগে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম তথ্য সংগ্রহের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে তাঁকে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে নিগ্রহ করা হয় এবং শত বছরের পুরোনো অফিশিয়াল সিক্রেটস আইনে মামলা দিয়ে জেলে পুরা হয়। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন। যারা সঠিক তথ্য গোপন করতে চান, সঠিক তথ্য প্রকাশে সমাজে যাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়, তারাই বেআইনি পথে সাংবাদিকের কাজে হস্তক্ষেপ করে থাকেন। পূর্বাপর সব সরকারের আমলে এই হস্তক্ষেপ হলেও ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জারির পর তা কয়েক গুণ বেড়েছে। বর্তমানে এই আইনে ৮১ জনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে।
আমরা আশা করি, সাংবাদিকেরা অবাধে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা প্রায়ই যে বাণী দিয়ে থাকেন, তা নিছক কথার কথা হবে না। বাস্তবেও এর প্রতিফলন দেখতে চায় দেশের মানুষ। এ ব্যাপারে ভারতের মতো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতও নির্দেশনা দিতে পারেন, যা মুক্ত সাংবাদিকতা তথা জনগণের তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
আদিত্ব্য কামাল: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ক্যাটাগরি: মিনি কলাম, সম্পাদকীয়